রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বাড়ছেই চালের দাম

প্রতিদিন ডেস্ক

চালের দাম হুহু করে বেড়েই চলেছে। মূলত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এ দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি বন্যার কারণে এ বছর হাওরে ধান উৎপাদন কম হয়েছে। অন্যদিকে সরকার দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে চাল আমদানির অনুমতিও দিয়েছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এতে কোনো গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।

রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চাল পাইজাম ও হাস্কি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা, আটাশ চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, মোটা চাল স্বর্ণা ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এসব চাল ৫ থেকে ৬ টাকা কম দামে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৫৮ থেকে ৬৬ টাকায়। নাজিরশাইল মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৪ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৬৫ থেকে ৮০ টাকায়। আটাশ চাল প্রতি কেজি এখন ৫৩ থেকে ৫৯ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। পাইজাম ৫০ থেকে বেড়ে ৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাস্কি চাল ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৩ হয়েছে। মোটা স্বর্ণা প্রতি কেজি ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে মিল মালিকদের বিকল্প উপায়ে ধান থেকে চাল করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় তাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সামনে চালের দাম আরও বাড়তে পারে। এদিকে আমদানি কম হচ্ছে। যেটুকু বাজারে এসেছে, সেটাও দেশি চালের দামের প্রায় সমান। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের কারণে যে শুধু ভাড়া বেড়েছে তা নয়, চাল প্রক্রিয়াকরণের খরচও বেড়েছে। সে জন্য মিলগেটে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সামনে দাম আরও বাড়বে। তবে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ, মিল মালিকরা কারসাজি করে চালের দাম কিছুটা বাড়িয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহন খরচ। এসব কারণেই মূলত চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

এর আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, চালের পর্যাপ্ত উৎপাদন আছে, সরবরাহ আছে- অথচ চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধানের যদি ঘাটতি থাকত তাহলে আমদানি করে তা পুষিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু আমদানির লাইসেন্স দেওয়ার পরও তো আমদানি করেননি। ১৭ লাখ মেট্রিক টনের আমদানির অনুমতির জায়গায় মাত্র ৩ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করেছেন। তার মানে পর্যাপ্ত চাল আছে। প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়াতে হবে- এটা  কোনোভাবে মেনে নেওয়া হবে না। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুষ্টিয়া : ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে কুষ্টিয়ার চালের বাজারে। কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজি প্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। শুধু চাল নয়, কুষ্টিয়ার বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁচা মরিচ, তরি-তরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। এর মধ্যে ২৭০ টাকা খাচি (৩০ পিচ) ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা। বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দামও।

খুচরা ব্যবসায়ী ও একাধিক মিলারের কথা, মূলত তিনটি কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত সরকার ডিজেলের মূল্য একলাফে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করায় পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ বাজারে ধানের দাম চড়া, সেই সঙ্গে ধানের সংকটও রয়েছে। ধান পাওয়া গেলেও দাম বেশি। তৃতীয় কারণ হিসেবে তাদের যুক্তি, সরকার চাল আমদানির সুযোগ দিলেও সেখানে ২৫% ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই ভ্যাট আরোপের কারণে ব্যবসায়ীরা কেউ চাল আমদানি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।

কুষ্টিয়ার খাজানগরের গোল্ডেন অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুজ্জামান জিকু বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্রাকপ্রতি পরিবহন খরচ ধান ও চাল উভয় ক্ষেত্রেই কমপক্ষে ২ হাজার টাকা বেড়েছে। এ ছাড়াও লোডশেডিংয়ের কারণে মিলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। চালের দামের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ধানের দামও।

কুষ্টিয়ায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম খাজানগরে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫০টি চালকল রয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ আকারের অটো রাইস মিলই রয়েছে প্রায় ৫০টি। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন এখান থেকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ট্রাক চাল লোড করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয়। যে কারণে কুষ্টিয়ায় ধান-চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব গিয়ে পড়ে গোটা দেশের ওপর। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির দুই দিন পর থেকেই কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম কেজি প্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে মিনিকেট চাল কেজি প্রতি ৪ টাকা। আর কাজললতা আর আঠাশ চাল কেজি প্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে কুষ্টিয়ার বাজারে অটো মিলের মিনিকেট চাল ৭০ টাকা, সাধারণ মিনিকেট ৬৮ টাকা, কাজললতা ৬০ টাকা, সাধারণ কাজললতা ৫৮ টাকা, অটো মিলের বাসমতি চাল ৮২ টাকা, সাধারণ বাসমতি ৭৮ টাকা, আঠাশ চাল ৫৫ টাকা এবং নাজিরশাইল চাল ৮২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

রংপুর : বোরো ধানের ভরা মৌসুমে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে চালের দাম  নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হাতে গোনা কিছু অটো রাইস মিল ও মজুদদার সিন্ডিকেট করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোডশেডিং, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় অটো রাইস মিলগুলো ঠিকমতো চালের সরবরাহ করতে না পারায় দাম বেড়েছে।

রংপুরের মাহিগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন চাল বাজারের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে মিনিকেট চালের (৫০ কেজি) বস্তা ছিল ৩ হাজার টাকা, সেই চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকা। ব্রিধান-২৮ (৮৪ কেজি) বস্তা ছিল ৩ হাজার ৩০০ টাকা, বর্তমানে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। ব্রিধান-৪৯ চালের বস্তা (৮৪ কেজি) ৩ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। পাইজাম (৫০ কেজি) ২ হাজার ১০০ টাকার স্থলে প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২

 হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। মোটা চাল বিভিন্ন প্রজাতির প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চালের এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ছোট ছোট হাসকিং মিল ও চাতালগুলো এখন আর চলে না। বড় অটো রাইস মিল মালিকরা কম দামে ধান কিনে মজুদ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক নিজেদের ইচ্ছামতো মজুদের পাহাড় গড়ে তুলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। অটো রাইস মিলগুলো লাখ লাখ মণ ধানের মজুদ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নির্ধারণ করছে। এ ছাড়া কিছু মজুদদার ব্যবসায়ীও চালের মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

রংপুরের মাহিগঞ্জসহ দিনাজপুরের পুলহাট, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে  যাচ্ছে। ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটো রাইস মিলের মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর