বুধবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

খন্দকার মোশাররফ কি এমপি পদ হারাচ্ছেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

খন্দকার মোশাররফ কি এমপি পদ হারাচ্ছেন?

মন্ত্রিসভার সদস্য, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ হারানো খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ‘এমপি’ পদও হারানো এখন সময়ের অপেক্ষায় মাত্র। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জেলায় একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন। মন্ত্রীদের মধ্যেও অনেক প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। মন্ত্রণালয় ও নিজ এলাকায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে তার মুখের কথাই ছিল অলিখিত আইন। কিন্তু এখন সেই প্রভাব আর নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমে বাদ পড়েন মন্ত্রিসভা থেকে। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লেও ‘ছায়া মন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ দেওয়া হয়।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে তাকে বাদ দেওয়া হয় দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকেও। গত রবিবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে।

সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। সেই হিসাবে আজ বুধবার পর্যন্ত তার টানা অনুপস্থিতির সংখ্যা ৮১ কার্যদিবস। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মেয়ের বাসায়। ২০২১ সালের এপ্রিলে তিনি সেখানে যান। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন। সেটা ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের ১২তম অধিবেশন। মাত্র তিন দিনের জন্য ওই অধিবেশন বসে। বর্তমানে চলছে একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশন। গত ৫ জানুয়ারি এই অধিবেশন শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ হিসাবে সংসদ অধিবেশনের জন্য রয়েছে আরও ১৬ কার্যদিবস। বিদেশে অবস্থানরত খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হলে দেশে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’ খন্দকার মোশাররফের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, তিনি শিগগিরই দেশে ফিরছেন না।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সংসদ অধিবেশন চলাকালে যদি কোনো এমপি দেশের বাইরে যেতে চান তাহলে দরখাস্তের মাধ্যমে আমাকে অবহিত করে যেতে হবে। কিন্তু খন্দকার মোশাররফ হোসেন যখন দেশের বাইরে যান তখন সংসদ অধিবেশন চলছিল না। এক্ষেত্রে অবহিত করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অনেক এমপি অধিবেশনের বাইরে বিদেশে গেলে আমাকে অবহিত করে যান। সংসদ সদস্য পদ বাতিল প্রসঙ্গে স্পিকার বলেন, টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে তখন বিষয়টি বিধি অনুসারে বিবেচনা করা হবে।’

জানা গেছে, সংসদের চলতি অধিবেশনের আরও ১০ কার্যদিবসে তিনি অনুপস্থিত থাকলে নিয়মানুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। এমপি পদ বাতিল সম্পর্কে সংবিধানের ৬৭ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি (ক) তাঁহার নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে নব্বই দিনের মধ্যে তিনি তৃতীয় তফসিলে নির্ধারিত শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিতে ও শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিতে অসমর্থ হন : তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পূর্বে স্পিকার যথার্থ কারণে তাহা বর্ধিত করিতে পারিবেন। (খ) সংসদের অনুমতি না লইয়া তিনি একাধিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকেন (গ) সংসদ ভাঙ্গিয়া যায় (ঘ) তিনি এই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন অযোগ্য হইয়া যান অথবা (ঙ) এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ক্ষেত্রে টানা অনুপস্থিতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সংসদে আর কোনো এমপির এত দিন টানা অনুপস্থিতির রেকর্ড নেই। সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাধারণত কোনো এমপি দেশের বাইরে গেলে স্পিকারকে নোটিসের মাধ্যমে অবহিত করে যান। দরখাস্তের মাধ্যমে ওই নোটিস করা হয়। তবে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিদেশে যাওয়ার আগে কোনো নোটিস করে যাননি। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কত দিনের জন্য যাচ্ছেন সে বিষয়ে স্পিকারকে কিছু বলেননি। টানা দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো তাকে সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৯ সালে তাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী করা হয়। পরে খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফরিদপুরে দলীয় রাজনীতিতে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় তার অনুগতরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়ন কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। ২০২০ সালের ৭ জুন বিশেষ অভিযান চালিয়ে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই দুজনই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এর দুই দিন পর ৯ জুন খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকায় চলে আসেন। এরপর ওই বছরের ১৪ জুলাই এক রাতের জন্য ফরিদপুর গিয়েছিলেন খন্দকার মোশাররফ। তারপর তার চাচির জানাজায় অংশ নিতে আরেকবার ফরিদপুর যান ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এরপর তাকে আর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দেখা যায়নি। গত বছরের ৭ মার্চ রাতে মোশাররফের ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেফতার হন তার সহকারী একান্ত সচিব ও জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক এ এইচ এম ফুয়াদ। দুজনকেই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ‘খন্দকার মোশাররফের বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমরা যতদূর জেনেছি, তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি স্পিকারকে অবহিত করা হয়নি। টানা ৯০ দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সংবিধান মতে জাতীয় সংসদ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এটি দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়।’

সর্বশেষ খবর