শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাষা নিয়ে ভাবনা

বিশ্বজিৎ ঘোষ

ভাষা নিয়ে ভাবনা

ঐতিহাসিক গৌরবদীপ্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয় ১৯৫২ সালে। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে দীর্ঘ একাত্তর বছর। সুদীর্ঘ এই সময়ে নানা ইতিনেতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে আমাদের জাতীয় জীবন। দীর্ঘ বঞ্চনা এবং নানামাত্রিক ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে আমরা মুক্তি লাভ করেছি, অর্জন করেছি আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। কিন্তু জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষা প্রভাব বিস্তা করতে পেরেছে কতটুকু? বাংলা ভাষা এগিয়েছে কতটা? বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থাই বা কেমন? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়, দেখা দেয় বাংলা ভাষার অফুরন্ত সম্ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ফল। অল্প কিছুদিনের জন্য প্রশাসন এবং আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হলেও দ্রুত তা থমকে যায়, দেখা দেয় ইংরেজির দাপট। সরকারি কর্মকর্তা ভুল ইংরেজি লিখলে লজ্জিত হন, কিন্তু ভুল বাংলায় তার কোনো ভাবান্তর হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উচ্চ জ্ঞানের কথা ইংরেজি ছাড়া বলতে পারেন না। সর্বত্রই চলছে ইংরেজি ভাষা, মনে হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বুঝি ইংরেজি। ঔপনিবেশিক আমলের চেনা পথেই চলছে স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষাবিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড। তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েও প্রকাশ্যেই নির্বাসনে যাচ্ছে যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান থেকে, উচ্চশিক্ষার সব স্তর থেকে।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা আজ খুবই শোচনীয়। বাংলা ভাষা নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য। দেখে মনে হয়, এ বিষয়ে কারও কোনো দায়িত্ব নেই। প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে এখন, বের হচ্ছে অনেক সংবাদপত্র। কিন্তু কোথাও কোনো নিয়মনীতি পালন করা হয় বলে মনে হয় না। বাংলা একাডেমির বইয়ে উপেক্ষিত হয় তাদের নিজেদের তৈরি ‘প্রমিত বানান রীতি’, স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের বইয়ে নির্দিষ্ট কোনো শব্দের নানান ধরনের বানান দেখা যায়, কখনো-বা একই বইয়ে। করপোরেট পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রসমূহে বাংলা ভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার সৃষ্টি করেছে বহুমুখী বিভ্রান্তি, বানানরীতিতে মানা হচ্ছে না ব্যাকরণের নিয়মরীতি, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে বেতারে প্রচারিত হচ্ছে উদ্ভট জগাখিচুড়ি ভাষার অনুষ্ঠান। বারবার নানান ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষার জন্য মায়াকান্না আর আবেগ ঝরে পড়লেও মার্চে তা আবার এক বছরের জন্য নির্বাসনে যায়।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে বাংলা একাডেমি এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বাংলা ভাষাকে কর্ম তথা বৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে মেলাতে হবে বাংলা ভাষা। সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের সব কাজ বাংলায় পরিচালনের জন্য কড়া নির্দেশ দিতে হবে। দোকান বা প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলায় লেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ জারি করতে হবে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে জাতীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, যেমনটি বিবেচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বিষ্ণু দে একটি কাব্যের নাম রেখেছিলেন ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ?’। বাংলাদেশে বাংলা ও আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষার দুরবস্থা দেখে বিষ্ণু দের অনুসরণে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা জাগে- ‘তুমি শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি?’ এ কথা আমরা জানি, ব্যক্তির পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া যত সহজ, ভাষান্তরিত হওয়া ততটা সহজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রবণতার দিকে তাকালে আমাদের বলতে ইচ্ছা করে, ব্যক্তির পক্ষে ভাষান্তরিত হওয়াটাও বোধ করি ততটা কঠিন নয়। রাষ্ট্রভাষাকে অবজ্ঞা করার এ প্রবণতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। তাহলে কি একুশের শহীদদের মতো আমাদের আবার বলতে হবে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাংলা ভাষার প্রকৃত রাষ্ট্রায়ন চাই’?

লেখক : একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর