১৯৭১ সালের ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের আগে, বাঙালি আরও একবার স্বাধীনতার পতাকা তুলেছিল। সেটা ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বরে আন্দামান নিকোবর দ্বীপের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে। সেদিন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাঙালির প্রাণপুরুষ সংগ্রামী নায়ক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি সুভাষ চন্দ্র বসু।
বাঙালি জাতির ইতিহাসের সংগ্রহশালায় পতাকা উত্তোলনের দুটি ঘটনাই কেবলমাত্র সংরক্ষিত আছে। ’৭১-এর ২ মার্চ বাঙালির জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের চূড়ান্ত আকাক্সক্ষার রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনায় এবং নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। পতাকা উত্তোলনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ, জগন্নাথ হল ও নীলক্ষেত এলাকা ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের- নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও আমিসহ আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশে হাজির হই তখন হাজার হাজার মানুষের মুখে একটাই ধ্বনি ‘উপরে উঠুন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’ তখন আমরা বাধ্য হয়ে কলা ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের বারান্দায় উঠে সভা শুরু করি। এখানে দাঁড়িয়ে পতাকা তোলার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে কী অনুভব-কী তাণ্ডব ছিল তা কোনোদিন প্রকাশ করতে পারিনি। এ আলোড়ন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভবও নয়। পতাকা উত্তোলনের ঘটনা মুক্তিকামী ছাত্র-যুব-জনতাকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে কীরকম তীব্রতায় আন্দোলিত করে পাগলপারা করে তুলেছিল তার বর্ণনা বিএসএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) সদস্য, সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন পেয়ারার একটি লেখা থেকে আংশিক উদ্ধৃত করছি-
‘‘সেদিন যারা ঐ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন কেবল তারাই এর ভিতরের আগুন দেখেছিলেন, তার উত্তাপ অনুভব করেছিলেন। পঞ্চাশ বছর পর তার বিবরণ দেওয়া অসম্ভব। যদি এক লাখ মানুষ থেকে থাকতেন তা হলে ঐ এক লাখের প্রত্যেকে ছিলেন অগ্নুৎপাতরত এক একটি জীবন্ত মানবাগ্নেয়গিরি। গগনবিদারী স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো এলাকা থর থর করে কাঁপছিল। আমাদের শরীরে তখন মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুতের বিস্ফোরক উদ্দাম উম্মাদনৃত্য। জয় বাঙলা। তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। টগবগ করে ফুটতে থাকা সেই জনসমুদ্রের ফুটন্ত জলরাশি ভেদ করে জাহিদের বাহিনী এসে কলাভবনের গাড়ি বারান্দার নিচে থামল। জাহিদ ফ্ল্যাগ মাস্টটি ছাদের ওপর দাঁড়ানো আ স ম আবদুর রবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। রব সেটি সমবেত জনতার সামনে তুলে ধরলেন। তখন চারদিকে কেবল স্লোগান, স্লোগান, স্লোগান। গলা ফাটানো, কান ফাটানো, আকাশ ফাটানো স্লোগান। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল কলাভবনের প্রতিটি ইট, ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছ যেন মত্তজনতার অংশ হয়ে একযোগে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রতিটি গাছের পাতা যেন আ স ম রবের হাতে ওড়ানো স্বাধীন বাংলার এক একটি পতাকায় পরিণত হয়েছিল। ইতিহাস কখনো এসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে না।”নেতাজি ভারতের পতাকা উত্তোলক। পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রশ্নে মানুষের অনমনীয় সংকল্প ও অদমনীয় আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাহসিকতাই ঐতিহাসিকতা। ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার জন্য নেতাজি নিজের দেশ ত্যাগ করেছেন এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। আর আমরা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে নিজ দেশ ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। আমাদের সংগ্রামের লক্ষ্য- স্বাধীনতা। নেতাজি দেশমাতৃকার তরে ইহজীবন থেকে চিরতরে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পর আজও স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরন্তর সংগ্রামে জড়িত আছি।
লেখক : জেএসডি সভাপতি