সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়

 মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়

একাত্তরের নয় মাসের পর্বটি ছিল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে শুধু ১৯৭১ সালের নয় মাসের ঘটনাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে ভাবেন, তাঁদের ভাবনাটা সঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধ গড়ে ওঠে বহু আগে থেকে, বছরের পর বছর ধরে জনগণের অধিকার আদায়ের বহুমুখী সংগ্রামী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিসহ গোটা ভারতবাসী যে রক্তঝরা সংগ্রাম করেছিল, তা-ও ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সে লড়াই ছিল সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণের হাত থেকে জাতীয় মুক্তি অর্জনের।  সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীনসহ যাঁরা অকাতরে জীবন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁদেরও আমি আমাদেরই মুক্তিসংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচনা করি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা মুসলিম ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগিতায় আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বিপথে পরিচালিত করে সাম্প্রদায়িক বিচার-বিতর্কে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজেরাও বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল নির্মম ও তীব্র জাতিগত শোষণের অতিরিক্ত বোঝা। বিজাতীয় শোষণ-শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি তাদের এ করুণ পরিণতি মেনে নেয়নি। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল গণপ্রতিরোধ। ভাষা, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, শোষণমুক্তি, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের অবসান প্রভৃতি দাবিতে রচিত হয়েছিল বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি, আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই, ’৬০-এর দশকের শিক্ষা আন্দোলন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৃষকের বাঁচার দাবিতে সংগ্রাম, ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব শাহির পতন ইত্যাদি বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামকে পরিপুষ্ট করে তুলেছিল। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানি শাসকরা গণরায় অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। তারা চালিয়েছিল নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কামান, বন্দুক, মর্টার, ট্যাংক, জঙ্গিবিমান ইত্যাদি দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম রুদ্ধ করতে পারেনি। সশস্ত্র প্রতিরোধে গর্জে উঠেছিল লাখো কোটি বাঙালি। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছিল। বাঙালির সে লড়াই হঠাৎ শুরু করে দেওয়া কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন ছিল না। মার্চে শুরু হওয়া সশস্ত্র প্রতিরোধের নয় মাসের পর্বটি ছিল বহু বছর ধরে চলতে থাকা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার ধারার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্র-অভিমুখিতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আজ স্বাধীনতার এত বছর পর গণতন্ত্র খর্বিত, ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, দেশ এখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শিকার ও বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির পদানত। দেশ চলছে সমাজতন্ত্রের বিপরীতমুখী লুটেরা ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির ধারায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা আজ বুর্জোয়া শাসকদের দ্বারা পদদলিত। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। শহীদের রক্ত বৃথা হয়ে যেতে দেওয়া যায় না। তাই আজ প্রয়োজন উত্তাল সেই মার্চের মতো আরেকটি জাগরণ।

সর্বশেষ খবর