রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

জরায়ু ক্যান্সার টিকা নিয়ে ভয়ংকর প্রতারণা

টার্গেট ছিল সারা দেশ, মূল হোতাসহ আরও চারজন নজরদারিতে, এখনো অনেকেই জানেন না টিকা নকল ছিল, পরবর্তী ডোজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন

সাখাওয়াত কাওসার

রাজধানীর বনশ্রী এলাকার ফারজানা ইয়াসমিন। স্বামী স্পেশাল ব্রাঞ্চে কর্মরত একজন পুলিশ পরিদর্শক। হিমেল গংদের চটকদার প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। ডিসেম্বর মাসে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে প্রথম ডোজ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ডোজ দিয়েছেন জানুয়ারি মাসে। প্রতি ডোজ টিকার জন্য তিনি আড়াই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। মে মাসের   জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন শেষ ডোজ অর্থাৎ তৃতীয় ডোজ দেবেন। একই অবস্থা সাবিনা ইয়াসমিন, সালমা আক্তারদের। এ তো গেল মাত্র বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে প্রতারকদের একটি কেন্দ্রের তথ্য। বর্তমানে কেবল ঢাকা ও গাজীপুরে প্রতারণার জাল বিস্তৃত করেছিল এই প্রতারক চক্র। ক্রমান্বয়ে সারা বাংলাদেশই ছিল তাদের টার্গেট। জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিষেধক টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দেশীয় দুটি কোম্পানি ইতোমধ্যে টিকাটি বাজারজাত করছে। ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে যৌনজীবন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্তও এই টিকা দেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে প্রতারক চক্রটি ফারজানা ইয়াসমিনের মতো দুই সন্তানের মাকেও টিকা দেওয়া থেকে বাদ দেয়নি। তার মতো আরও অনেক নারী তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, টিকা দেওয়ার আগে এলাকায় মাইকিং করা হতো। জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিষেধক টিকার বাইরেও সেই সব সেন্টারে পুরুষদের হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দেওয়া হতো। এ প্রতিবেদকের কাছে ভয়ংকর প্রতারক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হিমেল সিদ্দিক ওরফে আবুবক্কর সিদ্দিক হিমেল এবং তার সহযোগী সাইফুল ইসলাম শিপনের একটি ফোনালাপের কনটেন্ট এসেছে। ওই ফোনালাপে ভুয়া ভ্যাকসিন তৈরি ও প্যাকেজিংয়ের অনেক কিছুই ছিল। জানা গেছে, ইতোমধ্যে ঢাকা ও গাজীপুরে ১৫০টি কেন্দ্রে বুথ তৈরি করে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের এই চক্রটি নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে অন্তত ছয় হাজার জনকে। তাদের টার্গেট ছিল পর্যায়ক্রমে সারা বাংলাদেশেই তাদের প্রতারণার জাল বিস্তৃত করা। ভুক্তভোগীরা কেউই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। এখন জানার পর তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে শঙ্কিত। এ চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম সবুর বলেন, খুবই স্পর্শকাতর এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও গাজীপুরের কেন্দ্রগুলো তারা কীভাবে ম্যানেজ করেছিলেন, নেপথ্যে কারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে ভারত থেকে অবৈধ পথে হেপাটাইটিস-বির আমদানি-নিষিদ্ধ ভ্যাকসিন ‘জেনেভ্যাক-বি’ এনে তা দিয়ে জরায়ু ক্যান্সারের নকল ভ্যাকসিন বানিয়ে আসছিল হিমেল-শিপন চক্র। ৩৫০ টাকায় কেনা একটি জেনেভ্যাক অ্যাম্পুল ভেঙে ১০টি নকল অ্যাম্পুলে ভরা হতো। সেগুলো সরবরাহ করা হতো জরায়ু ক্যান্সারের ভ্যাকসিন ‘সারভারিক্স’ হিসেবে। এভাবে দুই বছরে তারা অন্তত ছয় হাজার নারীকে নকল ভ্যাকসিন দিয়ে হাতিয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি। শিপন ছাড়া অপর চারজন হলেন- ফয়সাল আহমেদ, আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম। এই গ্যাংয়ের মূল হোতা হিমেলসহ আরও চারজনকে এরই মধ্যে গোয়েন্দাজালে আটকিয়েছে ডিবি পুলিশ। তবে ইতোমধ্যে নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণা ও বাজারজাতকরণে ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, আল নূর ফাউন্ডেশন ও পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। তবে প্রকৃতপক্ষেই তাদের কী ভূমিকা ছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে দাবি করা হয়, প্রতারকরা হয়তো তাদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে। অপারেশনে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিচ উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল চক্রটি। মূলহোতা হিমেলকে গ্রেফতারের পর অনেক কিছুই স্পষ্ট হবে।

কারণ তার কারখানা থেকে কমপক্ষে ৮৫ লাখ টাকার নানা ধরনের ওষুধই আমরা জব্দ করেছি। ওই ওষুধগুলো আসল নাকি নকল, এর বিশেষত্ব কী তা পরীক্ষার পরই সে বিষয়ে জানানো যাবে। তবে হিমেলকে গ্রেফতারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। জানা গেছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হওয়ার কারণে অনেক কিছুকেই তিনি পাত্তা দিতেন না হিমেল। ভয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না অনেকেই। তার নিজ বাড়ির পাশেই আরেকজনের জমি দখল করে তাতে একটি কারখানা তৈরি করেছেন। সেখান থেকেই নকল ভ্যাকসিন প্রস্তুত, প্রচারণা, বাজারজাতসহ সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হতো। হিমেল সিদ্দিক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহসভাপতি এবং বর্তমান কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য। তবে থানা সভাপতি হাজী মিরাজুর রহমান সুমন এবং সাধারণ সম্পাদক হাজী রমজান আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে হিমেলকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেখানে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ আনা হয়। হিমেলের বাবা মীর মোহাম্মদ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। তার দাবি, আলট্রাসনোগ্রাম ও থেরাপি দেওয়ার সময় ব্যবহৃত এক ধরনের জেল তৈরির কারখানা চালু করেছিলেন হিমেল। ভ্যাকসিন তৈরির কথা তিনি কখনো শোনেননি। সোহাগ নামে এক যুবক ছিলেন তার ব্যবসায়িক অংশীদার। তার সঙ্গে টাকার ভাগ নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর