পাইকারি বাজারে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবু বাড়ছে সব নিত্যপণ্যের দাম। বর্তমানে চালের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। বাজারে প্যাকেটজাত চিনি উধাও। গরম মসলার উত্তাপ দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে আরেক দফা বাড়ল সয়াবিন তেলের দাম। ৫০ টাকার নিচে নেই কোনো সবজি। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের অবস্থা ত্রাহি। এর থেকে পরিত্রাণের আপাতত কোনো উপায় কেউ বলতে পারছে না। এ ব্যাপারে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জীবনযাত্রার মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে গেছে। অনেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন ভোগ্যপণ্যের দাম কমতির দিকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি ঠিকভাবে কাজ করছে না। বাজার মনিটরিংয়ের ঘাটতিও রয়েছে।
সরেজমিনে রাজধানীর কয়েকটি বাজার পরিদর্শন, বাসিন্দা ও দোকানদারদের সঙ্গে আলাপ, বিভিন্ন অনলাইন শপে পণ্যের মূল্য যাচাই ও ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাসের ব্যবধানে অন্তত ৪৩ ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গত বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৭৪ ভাগ পণ্যের দাম। মে মাসের শুরুতে দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫-১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে প্যাকেটজাত চিনি। আগের মজুদকৃত ১১২ টাকা কেজির প্যাকেট চিনি খুলে ১৩৫-১৪০ টাকায় বিক্রি করছেন অনেক দোকানি। মাছ, মাংস, ডিম, মসলা, ফল, গুঁড়া দুধ, ভোজ্য তেল, বেকারিপণ্য, ডায়াপার, নুডলস, সাবানসহ অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। বোতলজাত ৫০০ মিলি পানির দামও ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা হয়ে গেছে। ২০৫ মিলি সফট ড্রিংসের দাম ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। ছোট হয়ে গেছে বিস্কুট ও পাউরুটির প্যাকেট। বাজারভেদে পণ্যের দামেও বড় পার্থক্য দেখা গেছে। খিলক্ষেত, মিরপুর, বাড্ডার বিভিন্ন স্থানে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন সুপারশপ ও অনলাইন শপে হাড়সহ গরুর মাংস ৭৯০-৮৪০ টাকায় ও হাড় ছাড়া ১১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। দুই মাস আগে বাজারভেদে প্রতি কেজি হরিণা চিংড়ি বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। গতকাল খিলক্ষেত বাজারে সকালে ৭৫০ টাকায় ও দুপুরে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অনলাইন শপ চালডাল ডট কমে বিক্রি হয়েছে ৯৫৬ টাকায়। পিঁয়াজ মাসের ব্যবধানে ৩০-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৮০-১২০ টাকা মূল্যের দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৮০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে ২২০-২৪০ টাকায় ও চিকন চাল আগের মতো ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুপার শপে চামড়া ছাড়ানো ১ কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৯০ টাকায়। মাসের ব্যবধানে খুচরা বাজারে আলুর দাম কেজিতে ১০ টাকা, জিরায় ১০০ টাকা, ফার্মের মুরগির ডিম ডজনে ১০ টাকা বেড়েছে। এক মাসে মাছের দাম তেমন না বাড়লেও মূল্য চড়া। মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে মুরগির গিলা-কলিজার। গতকাল বাজারগুলোয় গিয়ে অনেক মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তকে গিলা-কলিজা কিনতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে বাড্ডার মুরগি বিক্রেতা মোজাম্মেল বলেন, আগে গিলা-কলিজা-পা তেমন বিক্রি হতো না। হোটেলগুলোয় দিতাম। এখন জমা হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়।
এদিকে বাজারে এ অস্থিরতার মধ্যেই ফের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন নতুন এ দাম নির্ধারণ করে শিগগিরই কার্যকরের ঘোষণা দিলেও গতকালই ঢাকার বিভিন্ন দোকানে নতুন দাম কার্যকর করে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সন্ধ্যায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৯৯ টাকায় ও ২ লিটারের বোতল ৩৯৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। ভোজ্য তেল আমদানিতে সরকারের দেওয়া ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ৩০ এপ্রিল শেষ হয়ে যাওয়ায় এ দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খিলক্ষেতের খুচরা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, সব চালের দামটা গত দুই মাসে বাড়েনি। অন্য সবকিছুর দামই বেড়েছে। এমনটি লকডাউনের আগে ১৫০ গ্রাম ওজনের যে সাবানের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন ৮৫ টাকা। গত ১৫ দিনের মধ্যে অধিকাংশ বিস্কুটের কার্টনে (২৪ প্যাকেট) ২৫-৩০ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে খুচরা দাম বাড়েনি। ১০ টাকার বিস্কুটের প্যাকেটের ওজন ৬ গ্রামের মতো কমে গেছে। আমাদের এখন বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, কিন্তু লাভ কমে গেছে। মাছ-মাংস নয়, দামের কারণে সবজি খেয়েও বাঁচতে কষ্ট হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। গতকাল নতুনবাজার ঘুরে দেখা যায়, কাঁচা মরিচ ১০০-১২০, করলা ৮০, ঢেঁড়স ৬০-৭০, পটোল ৫০-৮০, শজনে ১৪০, পেঁপে ৭০-৮০, বেগুন ৬০-৮০, বরবটি ৮০, কাঁকরোল ৮০, চিচিঙ্গা ৬০, শসা ৬০, গাজর ৮০, ঝিঙা ৮০, কচু ১২০, কচুর লতি ৮০, টম্যাটো ৪০, মিষ্টিকুমড়া কেজি ৩০-৩৫ টাকা কেজি এবং লাউ পিস ৬০, চালকুমড়া ৫০-৬০, ৩০০ গ্রাম ওজনের ফুলকপি ৪০, পাতাকপি ৬০, লেবু ৩০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে লাগামহীন ‘ঘোড়দৌড়’ চলছে চিনি ও তেলের বাজারে। গত ১০ দিনের ব্যবধানে এ পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৫০০ টাকা। আর ঈদুল আজহার দুই মাস বাকি থাকলেও এক মাসের ব্যবধানে মসলার কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, বাজারে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কিন্তু ঈদের ছুটির পর এখনো পুরোদমে চালু হয়নি খাতুনগঞ্জ। পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত গাড়ির চালক, হেলপার, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে কাজে যোগদান করেনি। তাই সরবরাহ চেন বিঘ্নিত হচ্ছে। এজন্য ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি। সরবরাহ চেন স্বাভাবিক হলে বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
খাতুনগঞ্জের অন্যতম আড়তদার সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘এখন ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিরের জন্য যৌক্তিক কারণ লাগে না। মজুদদার সিন্ডিকেটের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। পান থেকে চুন খসলেই মজুদদাররা হুহু করে বাড়িয়ে দেয় পণ্যের দাম। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীর কিছুই করার থাকে না।’
জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট এবং আমদানিকারকরা প্রত্যাশিত এলসি খুলতে না পারার কারণে অস্থিরতা চলছে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে। এ অস্থিরতার কারণেই কয়েক মাস ধরে হুহু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানের ছুটির পর প্রথম দিন থেকেই বাড়তে থাকে ভোগ্যপণ্যের দাম। গত ১০ দিনের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম মণপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫০ টাকা। বৃহস্পতিবার সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৪৫০ টাকা মণ। ৪ হাজার ৬৫০ টাকা মণের পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। ৪ হাজার ১০০ টাকা মণের চিনি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৬০০ টাকা। ঈদুল আজহার প্রায় দুই মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বাড়ছে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত। এক মাস আগে ধনে কেজি ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হলেও গতকাল খাতুনগঞ্জে বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকা কেজি। এক মাস আগের ১১২ টাকা কেজি দরের হলুদ ১১৯ টাকায়, ৩৮০ টাকা কেজি দরের ভারতীয় শুকনা মরিচ ৩৯০ টাকায়, ৩৫০ টাকা কেজি দরের দেশি শুকনা মরিচ ৮২০ টাকায়, ১ হাজার ২৮০ টাকা কেজি দরের এলাচ ১ হাজার ৪৮০ টাকায়, ১ হাজার ২৮০ টাকার লবঙ্গ ১ হাজার ৩৫০ টাকায়, ৫৮০ টাকার গোলমরিচ ৬৩০ টাকায়, ৩১০ টাকা দরের দারচিনি ৩২০ টাকায়, ৩০ টাকা দরের পিঁয়াজ ৫৫ টাকায়, ১৪০ টাকার চীনা আদা ৩৭০ টাকায়, ১২০ টাকার রসুন ১৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডালের দাম কমেছে।
খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে খাতুনগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি মজুদদার চক্র। তাদের হাতের ইশারায় উত্থান-পতন হয় ভোগ্যপণ্যের বাজার। বাজার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ডলার সংকট পরিস্থিতি। এ চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ ব্যাংক সেক্টরের সম্পৃক্ত। তারা চাইলেই এলসি করতে পারছেন, যা সাধারণ ব্যবসায়ীরা পারছেন না।