রবিবার, ২৮ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চার সিটিতে সতর্ক আওয়ামী লীগ

♦ শঙ্কায় বরিশাল ♦ বিশেষ দৃষ্টি সিলেটে ♦ কিছুটা নির্ভার খুলনা-রাজশাহী

রফিকুল ইসলাম রনি

চার সিটিতে সতর্ক আওয়ামী লীগ

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ের পর আসন্ন চার সিটি নির্বাচন নিয়ে সতর্ক আওয়ামী লীগ। ‘ভুল’ থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনী ফসল ঘরে তুলতে চান ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বরিশাল সিটিতে। নতুন প্রার্থী দেওয়ার কারণে কঠোর দৃষ্টি রয়েছে সিলেটে। দলের ভিতর ঐক্য থাকা এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় নির্ভার রয়েছে খুলনা ও রাজশাহী সিটিতে। খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন ১২ জুন এবং রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে হবে ২১ জুন। গাজীপুর থেকে শিক্ষা নিয়ে এই চার সিটিতে জয় পেতে চায় আওয়ামী লীগ। গাজীপুরে দলীয় প্রার্থী হেরে গেলেও বর্তমান সরকারের অধীনে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট’ সম্ভব এমন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নৌকার ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত গাজীপুরের মতো জায়গায় এবং আজমত উল্লার মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ের অভাব, মাঠপর্যায়ের নেতাদের বেইমানি, আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট বেশি পড়ায় পাঁচ সিটি ভোটের শুরুতেই হোঁচট খেল ক্ষমতাসীন দলটি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু ফলাফল এমন হবে ভাবতে পারিনি। গাজীপুর আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। এখন যে চারটি সিটিতে ভোট রয়েছে, গাজীপুরের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করব ইনশাআল্লাহ।’

জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের অবস্থান সংহত এবং দলটি অনেকটা নির্ভার। এ দুটি হলো- রাজশাহী ও খুলনা। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি এর আগেও মেয়র ছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজশাহীর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি এখন রাজশাহীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো, যদি বিএনপির কোনো প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়াতেন। কিন্তু বিএনপির এখানে প্রার্থী না হওয়ায় অন্য যারা প্রার্থী হয়েছেন, তারা অত্যন্ত দুর্বল। ধারণা করা হচ্ছে, এখানে সহজ জয় পাবেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন।

তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীতে শক্তিশালী প্রার্থী না থাকলেও দলের ভিতরে খুব যে ঐক্য আছে সেটাও বলার সুযোগ নেই। রাজশাহী সিটিতে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। ডাবলু সরকারের সঙ্গে খায়রুজ্জামান লিটনের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। সিটি নির্বাচন সামনে রেখেও সেটা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। বরং পাশ কাটিয়ে চলার অভিযোগ রয়েছে। ডাবলুর ভগ্নিপতি জেলা পরিষদের প্রশাসক মীর ইকবাল, ভাগ্নে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইসতিয়াক আহমেদ লিমন, ভাই জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেড সরকার, আরেক ভাই শ্রমিক নেতা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বদিউজ্জামান খায়েরকে ডাকা হয় না প্রচার-প্রচারণায়। অবশ্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মহানগরের রাজনীতিতে নেই, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আছি। এ ছাড়া আমি প্রার্থী। মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিসহ অনেকেই ডাবলু সরকারকে একাধিকবার ডেকেছেন। কীভাবে ডাকলে তিনি আসবেন আমার জানা নেই। তবে বিশ্বাস করি, তার অভিমান থাকতেই পারে, দিন শেষে নৌকার পক্ষেই সে মাঠে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কখনো নৌকার বিপক্ষে যেতে পারে না।’ অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের এলাকা বর্ধিত করার একটা পরিকল্পনা রয়েছে। সিটি বর্ধিত করা হলে রাজশাহী-৩ আসনে মধ্যে যাবে। এ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন চান না তার এলাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে পড়–ক। আবার ওই আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চান মেয়রের মেয়ে ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। এ নিয়ে আয়েনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে নগরীর একটি মার্কেটের সামনে দোকান বসানো নিয়েও মেয়রের দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা বাইরে থেকে ভোটের মাঠে বিরোধিতা না করলে লিটনের পাস সহজ হবে। রাজশাহী মহানগর ও জেলার একাধিক নেতা জানান, যারাই বিরোধিতা করুক না কেন নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত। চার সিটির মধ্যে খুলনাতে অবস্থা সবচেয়ে ভালো। খুলনাতে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল নজরুল ইসলাম মঞ্জুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির কোনো নেতাই এই নির্বাচনে দাঁড়াননি। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আর কোনো বড় প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। দলের নেতা-কর্মীরাও তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। তাছাড়া খালেক একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবেই পরিচিত। আর এ কারণেই এই নির্বাচনে তার সহজ জয়ের সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এবার সিলেট সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নতুন মুখ। তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সিলেট সিটি নির্বাচন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কথা ছিল এবং আওয়ামী লীগ এই সিটি নির্বাচন নিয়েই বেশি শঙ্কিত এবং সন্দিহান ছিল। কিন্তু এখন সিলেটে সহজ জয়ের অপেক্ষায় আওয়ামী লীগ। সিলেটের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। আর তার এই সরে দাঁড়ানোর ফলে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এখন প্রতিদ্বন্দ্বিহীন। এখানে জাতীয় পার্টির যে প্রার্থী আছেন, সেই প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তবে সিলেটে দৃষ্টি আছে কেন্দ্রের। কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তারা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিভিন্ন মতবিনিময়, কর্মিসভায় যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে যে প্রচার-প্রচারণা করবেন তা আপাতত দৃশ্যমান হচ্ছে না। আবার সিটি নির্বাচনে আগে ছিল ২৭টি ওয়ার্ড। নতুন করে যুক্ত হয়েছে ১৫টি ওয়ার্ড। এই ১৫টি ওয়ার্ড বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়াও অন্য কারণ হচ্ছে, সিলেটে নৌকাবিরোধী ভোট বেশি। ভোটার উপস্থিতি বেশি হলেও সংকট সৃষ্টি হবে। সবকিছু মিলিয়ে নৌকার বিজয়ের মাধ্যমে দলের নেতা-কর্মীরা প্রমাণ করতে চান, বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের যোগ্য উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে প্রার্থী করা হয়েছে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতকে। এ সিটিতে মেয়র ছিলেন তার ভাতিজা বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ। একই পরিবারের হলেও রয়েছে দ্বন্দ্ব। গত শুক্রবার বরিশাল আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে একটি বর্ধিত সভা করা হয়। কেন্দ্রের নির্বাচনী পরিচালনা টিমের নির্দেশে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এই সভা আহ্বান করে। কিন্তু সভায় যাননি প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। আবার দেখা যায়নি সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকেও। বরিশাল সিটিতে এখন চলছে ‘প্রভাব’ বিস্তারের রাজনীতি। সভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজী নাঈমুল হোসেন লিটু এই বর্ধিত সভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ উপস্থিত না থাকার কারণ জানতে চান। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর সভায় বলেন, আমরা শুরু থেকেই নৌকার পক্ষে কাজ করতে চেয়েছি। আমাদের কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমরা ঘরে বসে থাকি। আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সভায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, আমরা যাতে নৌকার পক্ষে কাজ করতে পারি সেই পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়ে যান। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নৌকার মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে বরিশালে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। আজকের বর্ধিত সভার মধ্য দিয়ে সব ভেদাভেদের অবসান হলো। নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, কোনো অঘটন ঘটলে এই নির্বাচন পরিচালনার যিনি টিম লিডার তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ দেখাবেন কীভাবে। আর নেতা-কর্মীরাই বা টিম লিডারের কাছে দাঁড়াবে কীভাবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ১২ জুন নৌকা বিজয়ী করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে একটা গন্ধ পাচ্ছি। জেতার আগে যদি কেউ জিতে যায়, তাহলে সে জিততে পারে না। সিটি নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের একটি প্রস্তুতি, রিহার্সাল। এই নির্বাচনে জেতার জন্য যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। আমার ধারণা আমার ভাই খোকনের চারপাশে চার-পাঁচটা লোক আছে, যারা তাকে ভুল বোঝাচ্ছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম আমরা করব। এই টিম দুষ্টচক্র খুঁজে বের করবে।

সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচন আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের একটি ব্যারোমিটার। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিটি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা কসম কেটে মাঠে নামলে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হবে। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতারা ভাইয়ের (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ) নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই নির্দেশ দেওয়ার জন্যই এই বর্ধিত সভা করা হয়েছে। বরিশাল সিটি নির্বাচনে নৌকা বিজয়ী করে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেব। এই জয়ের মধ্য দিয়ে হাসানাত ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করব এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। এ সিটিতে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও হাতপাখার প্রার্থী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করীম বেশ শক্তিশালী। কারণ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখনো দূর হয়নি, বিএনপির কোনো প্রার্থী মাঠে নেই। কাজেই দুই সমীকরণ কাজে লাগিয়ে হাতপাখার প্রার্থী বাজিমাত করতে চান।

সর্বশেষ খবর