বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটের বাজেট আজ

♦ আইএমএফের চাপ সামলানো ও জনতুষ্টির চেষ্টা থাকবে অর্থমন্ত্রীর পরিকল্পনায় ♦ স্বাধীনতার পর প্রথম বাজেট ছিল ১৯৭২ সালে ৭৮৬ কোটি টাকার ♦ ৫২তম বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ♦ আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম বাজেট

মানিক মুনতাসির ও শাহেদ আলী ইরশাদ

ভোটের বাজেট আজ

সংবিধান মোতাবেক আগামী সাত মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন। সে অনুযায়ী চলতি বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। সে হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটটি হবে ভোটের বাজেট। আজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি মুস্তফা কামালের দায়িত্বকালের পঞ্চম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম ও স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। বাজেটের প্রথম ছয় মাস বাস্তবায়ন হবে বর্তমান সরকারের আমলে। পরের ছয় মাস করবে পরবর্তী সরকার। ডলার সংকট কাটাতে আইএমএফ-বাংলাদেশের চলমান ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের শর্তের প্রতিফলনও ঘটবে এ বাজেটে। কেননা আর্থিক খাতের সংস্কার, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, কৃষি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার বিষয়ে চাপ রয়েছে সংস্থাটির। এর পরও যেহেতু সামনেই সংসদ নির্বাচন তাই আবারও জনগণের রায় পেতে একটি জনকল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র।

জানা গেছে, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, করপোরেট কর না বাড়ানো, সরকারি চাকুরেদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো, চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি থাকবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। অবশ্য করোনা মহামারিতে সম্প্রসারিত হওয়া টিসিবির ফেয়ার প্রাইস কার্ড কর্মসূচি ও ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানোর ঘোষণা থাকবে আজকের বাজেট বক্তৃতায়। দফায় দফায় জ্বালানির দাম বাড়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অথচ সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে প্রতিনিয়ত। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সংকট ও আইএমএফের চাপকে সঙ্গে নিয়ে জনতুষ্টির চেষ্টাও করবেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে দেশ শাসনের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ। যদিও করের বোঝা বাড়ানোরই ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিপুল বাজেটের অর্থায়ন ঠিক রাখতে টিআইএনধারী নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষকেও ন্যূনতম কর দিতে হবে। এমন ঘোষণাই দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সরকার গঠন করে দলটি। যদিও এ দুই নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। আর আজ যে বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী, তার আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ১০০ ভাগ। আর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। অবশ্য দেশের মানুষের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ আজ উন্ননয়শীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। একসময় যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের নিচে, সে আয় এখন ৩ হাজার ডলার ছুঁইছুঁই করছে। এ অবস্থার মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারের প্রথম বাজেট হতে যাচ্ছে এটি। একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এটি হবে বাংলাদেশের শেষ বাজেট। পরবর্তী যে বাজেটটি আসবে (২০২৪-২৫), তা হবে উন্নয়নশীল দেশের বাজেট।

এ বছর ২৮, ২৯ ও ৩০ জুন ঈদুল আজহার ছুটি পড়ায় বাজেট পাস হতে পারে কয়েক দিন আগেই। এজন্য এ বছর বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা হয়তো কিছুটা কম হবে। রীতি অনুযায়ী কাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থমন্ত্রী। এরপর জুনজুড়েই বাজেটের ওপর সংসদে সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন সংসদ সদস্যরা। এবারের বাজেটের প্রধান শিরোনাম ‘উন্নয়নের দেড় দশক : স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। এ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙা করতে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বিশাল বর্ণনা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা ও চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা তুলে ধরবেন তিনি। বাজেট শুধু একটি আইন নয়, এটি যে কোনো নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দলিলও। ফলে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এ বাজেট কতটা জনকল্যাণমুখী তা-ও বিবেচনায় রাখছেন অর্থমন্ত্রী।

এদিকে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা, ডলার সংকট, বৈশ্বিক মন্দা ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের কৌশল কেমন হতে পারে বছরের শুরু থেকেই এ নিয়ে প্রচণ্ড চাপে রয়েছে অর্থ বিভাগ। এত সব চাপ সামলে স্মরণকালের অস্থির সময়ে স্বস্তির বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এমনিতেই বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মধ্যে আজ ১ জুন জাতীয় সংসদে বিশাল আকারের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

জিডিপি মূল্যস্ফীতি : সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা করছে অর্থ বিভাগ। এজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী। যদিও এপ্রিল, ২০২৩ শেষে মূল্যস্ফীতির চাপ প্রায় ২ অঙ্কের ঘরে উঠেছে।

বাজেটের আকার : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। চলতি বছরের বাজেটের মূল আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

এডিপি : আগামী অর্থবছরের জন্য উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত প্রকল্পে ব্যয় করা হবে ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন স্কিমে ব্যয় করা হবে ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।

রাজস্ব আয় : বাজেটের অর্থায়নের প্রধান আয়ের উৎস রাজস্ব খাত। এ খাতকে শক্তিশালী করতে নানামুখী কর্মসূচির কথা বলা হলেও রাজস্ব খাত এখনো ভঙ্গুর ও দুর্বল। আগামী বছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর মোট আয় ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

ঘাটতি : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার (অনুদান ছাড়া) ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেবে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা। নিট বৈদেশিক ঋণ নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

সরকারি চাকুরেদের বেতন : ডলার সংকট, বৈশ্বিক অচলাবস্থার কারণে প্রথমে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোকে আমলে না নিলেও শেষ মুহূর্তে এসে বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এর মাধ্যমে সরকারি চাকুরেদের খুশি রাখা যাবে বলে মনে করে সরকার। আর এটিকে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

করমুক্ত আয়সীমা : করমুক্ত আয়সীমা চলতি বছরের বাজেটে বাড়ানো হয়নি। আগের বছরেরটাই বহাল রাখা হয়। অথচ গত দুই বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে আরও বেশি। এ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা বাড়তে পারে করমুক্ত আয়সীমা।

করপোরেট কর : রাজস্ব আদায় বাড়াতে করপোরেট কর বাড়ানোর চাপ থাকলেও তা আমলে নেয়নি অর্থ বিভাগ। বরং নির্বাচনের বছর ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে করপোরেট কর না বাড়ানোর পক্ষে রয়েছে অর্থ বিভাগ।

সামাজিক নিরাপত্তা : সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের হিসাবে করোনা মহামারির পর দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় দি¦গুণ হয়ে গেছে। এসব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে পরিকল্পনা করছে সরকার। এ খাতের সব সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হবে আজকের বাজেটে। বিশেষ করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা ও স্বামীপরিত্যক্তা ভাতা, শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভাতার পরিমাণ এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর