দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে জরিপ দেখেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমি নিয়মিত জরিপ করছি। যারা জরিপে এগিয়ে থাকবেন, পাস করতে পারবেন, তাদেরই মনোনয়ন দেওয়া হবে। পাস করতে পারলে ভালো থাকবেন, না করতে পারলে জামায়াত-বিএনপির হাতে মার খাবেন।
গতকাল দুপুরে গণভবনে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বৈঠক সূত্র জানান, শুরুতেই বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে পাঁচ মিনিট বক্তৃতা করেন শেখ হাসিনা। এরপর নেতা-কর্মীদের কথা বলার সুযোগ দেন তিনি। এ সময় ৩০-৩৫ নেতা-কর্মী কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
সভায় গুরুদাসপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম দলীয় সভানেত্রীর উদ্দেশে বলেন, নেত্রী, আপনার অনেক সংস্থা রয়েছে। নাটোর-৪ আসনের খোঁজখবর নেবেন। আপনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমি তা মাথা পেতে মেনে নেব। তবে আপনি নৌকা দিলে আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক এমপি এ কে ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, নেত্রী আমার বয়স হয়েছে। সামনে নির্বাচন। এ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে আমার ছেলে আতাউল হক দোলনকে দলীয় মনোনয়ন দেবেন এটাই আমার দাবি। (আতাউল হক দোলন শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গণভবনে আসা আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিজেও সামনে সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে দলীয় সভানেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নিয়মিত জরিপ করছি। সামনে নির্বাচন অনেক কঠিন হবে। নির্বাচিত হওয়ার মতো জনপ্রিয়তা আছে- এমন ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেব। দলের মনোনয়ন সবাই চাইতেই পারেন। দাবি করলেই মনোনয়ন তো হবে না। জনপ্রিয়তা থাকতে হবে। বর্তমানে যারা এমপি আছেন, ভালো কাজ করছেন, তারাও মনোনয়ন পেতে পারেন। আর যারা জনবিচ্ছন্ন হয়েছেন, তারা পাবেন না- এটা সাফ কথা। ছয় মাস পর পর জরিপ করছি। জরিপ দেখেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। কার কোথায় কী অবস্থা, কে কাজ করছে, কার জনপ্রিয়তা আছে, কার নেই, সব আমার জানা আছে। বিজয়ী হওয়ার মতো লোককেই নৌকা দেওয়া হবে। জিততে পারলে ভালো, না পারলে বিএনপি-জামায়াতের হাতে মার খাবেন। এ সময় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনের তাগিদ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারে না। যখনই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকে তখনই জয় এসেছে। সামনে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত হবে। কাজেই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে। মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে বলেই দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা কমে গেছে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতে কী করেছিল সেটা মনে রাখবেন। কাজেই দলের ঐক্যের বিকল্প নেই।
জেলা নেতাদের মধ্যে থেকে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাউদ্দীন সিরাজ, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত, যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনসহ জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, বরগুনার তালতলী, পঞ্চগড়ের নেতারা। এ সময় বরগুনার তালতলীর সাংগঠনিক অবস্থা খারাপ তুলে ধরেন এক নেতা। আরেক নেতা দলীয় সভানেত্রীর সামনেই ওই নেতাকে বিএনপি থেকে হিজরত করা হাইব্রিড নেতা হিসেবে মন্তব্য করেন। এ সময় পক্ষে-বিপক্ষে কেউ কেউ কথাও বলেন। এতে কিছুটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তালতলী নেতাদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা তো সব সময় মিলে থাকতে পারও না, এটাই তোমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সে কারণেই তো আমি নিজে একবার তালতলীতে নির্বাচন করেছিলাম।
পঞ্চগড়ের এক নেতা চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি করেন। আক্কেলপুরের এক নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমার বাবাকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। আমার মাথার ওপর ছায়া নেই। নেত্রী আমাকে ছায়া দেবেন।
আগামী নির্বাচনটা একটা চ্যালেঞ্জ : একই সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আগামী নির্বাচনটা চ্যালেঞ্জের হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জীবন যখন একটু উন্নত হয়, তখনই বাংলাদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার আছে যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সব জায়গায় বদনাম করে বেড়ায়, মিথ্যা বলে বেড়ায়। আর কিছু আছে বিদেশি অনুদানের টাকা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয়। তিনি বলেন, যারা আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসই করেনি, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, লুটপাট করেছে, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন করেছে তারা আছে, তাদের আওলাদ আছে তারা সারাক্ষণ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেই যাচ্ছে। নির্বাচনে কারচুপি করা বিএনপির অভ্যাস মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ভোট চুরি করা, এটাই তাদের রেকর্ড। গণতন্ত্রহরণ করা, এটাই তাদের রেকর্ড। ওদের মুখে এখন আবার আমরা গণতন্ত্র শুনি। শেখ হাসিনা বলেন, যারা মিলিটারি ডিক্টেটরের হাতে তৈরি দলে, তাদের কাছে গণতন্ত্রের সবক শুনতে হয়। তাদের কাছে ভোটের কথা শুনতে হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনেও তো কম কারচুপি হয়নি। ১৯৯৬ সালে এই খালেদা জিয়াকেই বাংলাদেশের মানুষ ভোট চুরির অপরাধে বিতাড়িত করেছে। আবার ২০০৬ সালে নির্বাচনে ১ কোটি ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোট চুরি করতে গেছে তখনো জনগণের আন্দোলনেই তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়ে দলটির প্রধান বলেন, আমাদের সংগঠনটা যথেষ্ট শক্তিশালী। সংগঠনটা যেন আরও মজবুত থাকে। সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ত্যাগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দিনের পর দিন কারাবরণ, অত্যাচার, নির্যাতন, তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধ করে যুদ্ধাহত হয়ে বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজ- এখানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা, স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলা, জয় বাংলা মুছে ফেলা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলা, অনেক অপকর্মই করা হয়েছে। আসলে সত্য এক সময় না এক সময় উদ্ভাসিত হবেই। সত্য কেউ মুছে ফেলতে পারে না। আজকে সেটাই হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বলেন, আজকে ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। জয় বাংলা স্লোগান আবার ফিরে এসেছে। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আল্লাহর রহমতে এটুকু করতে পেরেছি এই ১৪ বছরে, ২০০৮-এ সরকারে আসার পর, এই একটানা ক্ষমতায়, ফলে যে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে বলেই আজকে বাংলাদেশের এ উন্নতিটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কিন্তু বাংলাদেশকে বদলে দিতে পেরেছি। আজকে কিন্তু সেই ভিক্ষুকের জাতি বলে কেউ আর অবহেলা করতে পারবে না। এ জায়গাটা থেকে বাংলাদেশকে উত্তরণ ঘটিয়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের তৈরি হতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। এটাকে আমাদের স্থায়ী করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, যে কোনো দুর্যোগে-দুর্বিপাকে আওয়ামী লীগই কিন্তু মানুষের পাশে থাকে। এটাও প্রমাণিত, যে কোনো সময় আওয়ামী লীগ মানুষের কাছে থাকে। তিনি বলেন, দেশের বাইরে গেলে সবাই বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ে আমাকে বলে, আপনার ম্যাজিকটা কী? আমি বলি ম্যাজিক কিছু নেই ওখানে। আমার শক্তিশালী সংগঠন আছে। আর আমাদের সংগঠনের শক্তিশালী নীতিমালা আছে। আমাদের একটা লক্ষ্য আছে, একটা পরিকল্পনা আছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে, জনগণকে নিয়ে উন্নয়নের কাজ করি বলেই আমরা সাফল্য আনতে পেরেছি।
সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে : এর আগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের করে এনেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর তাঁর পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ার ও বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না। এটি ছিল মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আজকে আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়ার পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে পেরেছি। আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করে। সরকার জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করেছে, যাতে মানুষ ভোগান্তির সম্মুখীন না হয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিচার পেতে পারে। চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে বিদ্যুতের কারণে জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এ সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন উপস্থিত ছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে দেশ রক্ষায় গাছ লাগান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় বৃক্ষরোপণ করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী গতকাল তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণকালে এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। পরিবেশ মেলা-২০২৩, জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা-২০২৩-এর উদ্বোধনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তিনটি চারা রোপণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আজ (গতকাল) বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমি গাছ লাগিয়েছি। আমি আশা করি, বাংলাদেশের সবাই (জনগণ) এটি (গাছ লাগাতে) অনুসরণ করবেন। বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের জনগণকে সংকট থেকে রক্ষা করতে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে। এ সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পরিবেশ উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ও পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।