রাজশাহীর পুঠিয়া ইসলামিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ আব্বাস আলী। তাকে ওই কলেজে নিয়োগ দেন তৎকালীন এমপি ডা. মনসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাকে এই কলেজে এমপি নিয়ে এসেছেন। উনারা (এমপির লোকজন) আমার কাছ থেকে চেক সই করে নিতেন। চেক সই করে নেওয়ার পর যখন কলেজে ৫-৬ মাসের টাকা জমা হতো, তখন ওই চেক দিয়ে আমাকে টাকা তুলতে বলতেন। আমি টাকা তুলতাম। প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে যেতেন। টাকা নিয়ে এসে প্রিন্সিপাল, সভাপতি উনারা সব নিয়ে চলে যেতেন। আর আমি এভাবে খালি হাতে ঘুরে যেতাম।’ শুধু বেতনের টাকা নয়, বোনাসের টাকাও তুলে দিতে হয়েছে এমপি ও তার লোকজনের হাতে।
এমপি ছিলেন মাত্র এক মেয়াদে (পাঁচ বছর)। সেই সময়ে এলাকায় নিয়োগ বাণিজ্য করেই শতকোটি টাকা কামানোর অভিযোগ আছে রাজশাহী-৫ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি ডা. মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে। নিয়োগ বাণিজ্য এবং অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুঠিয়া ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে দুই দফায় ১৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিজের পকেটে নিয়েছেন তৎকালীন এমপি ডা. মনসুর রহমান। শুধু পুঠিয়ার ওই একটি কলেজে নয়, তার নির্বাচনি এলাকা পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই কায়দায় নিয়োগ বাণিজ্য করে কয়েকশ কোটি টাকা কামানোর অভিযোগ এমপির বিরুদ্ধে।
কলেজ শিক্ষক হেদায়েত আলী জানান, নিয়োগ বাণিজ্য নির্বিগ্ন করতে এমপি মনসুর রহমান কলেজ পরিচালনা কমিটিতে তার ছেলে-মেয়ে ও পছন্দের লোকজনকে বানিয়েছেন সভাপতি। তাদের মাধ্যমেই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। মেয়ে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে গেলে মনসুর রহমান তার ছেলেকে কলেজের সভাপতি করেন। এভাবে দুই উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসিয়েছিলেন নিজের পছন্দের লোকজন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা চমক হিসেবেই আসে ডা. মনসুর রহমানের দলীয় মনোনয়ন। সেই নির্বাচনে তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১৪ লাখ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে দৃশ্যমান আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ লাখ টাকায়। যদিও দুদকে জমা পড়া অভিযোগ বলছে, এ সময়ে তিনি শতকোটি টাকার মালিক হয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। দুদক সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী-৫ আসনের সাবেক এমপি মনসুর রহমানের নির্বাচনি হলফনামা অনুসারে বার্ষিক আয় বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণেরও বেশি। অন্যান্য সম্পদের পরিমাণও ২০০ গুণ বেড়েছে। শিক্ষকতা, শেয়ার ও চাকরি থেকে বার্ষিক আয় দেখালেও সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে অভিযোগ আছে। গত ২৭ আগস্ট মনসুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্র্নীতি দমন কমিশন।
আইনজীবী কবিরুল ইসলাম সূর্যের দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে করা লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, এমপি মনসুর রহমান বিগত পাঁচ বছরে এলাকার উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছেন। ওএমএস, সার ডিলার নিয়োগ, কাবিখা-কাবিটার টাকা কমিশন নিয়েছেন। স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় নিয়োগবাণিজ্য, এমপিও করে দেওয়ার নামে অর্থ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও খাস পুকুরের ইজারা দেওয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, পুঠিয়ার চন্দনমাড়িয়া দাখিল মাদরাসা এমপিও করে দেওয়ার নামে ২০ লাখ, সাধনপুর উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ এমপিও করার নামে ২০ লাখ, সাধনপুর পঙ্গু শিশু নিকেতন ডিগ্রি কলেজ এমপিওর নামে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন মনসুর রহমান। এ ছাড়াও সাধনপুর পঙ্গু শিশু নিকেতন ডিগ্রি কলেজে ৪টি পদে নিয়োগ দিয়ে ৪৮ লাখ টাকা, সাধনপুর পঙ্গু ও শিশু নিকেতন হাইস্কুল থেকে ৪টি পদে নিয়োগে ৩২ লাখ টাকা, অমৃতপাড়া দাখিল মাদরাসার ৩টি পদে নিয়োগ দিয়ে ২৪ লাখ টাকা, সাতবাড়িয়া দাখিল মাদরাসায় ৩টি পদে নিয়োগ দিয়ে ২০ লাখ টাকা, সাতবাড়িয়া হাইস্কুলে ৩টি পদে ২১ লাখ টাকা, পচামাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে ৪টি পদে ২২ লাখ টাকা, পচামাড়িয়া হাইস্কুলে ৪টি পদে ৪৮ লাখ টাকা, তেঁতুলিয়া হাইস্কুলে ৩টি পদে নিয়োগ দিয়ে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন মনসুর রহমান। এনিয়ে কথা বলতে সাবেক এমপি মনসুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইলে কল করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। নগরীর বাড়িটিতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।