ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ দখলদারির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে ঢাকার বেশ কয়েকজন সাবেক এমপির বিরুদ্ধে। নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের এই এমপিরা হয়ে উঠেছিলেন নিজ নিজ এলাকার গডফাদার। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। নিজ এলাকায় এমপিদের মুখের কথাই ছিল আইন। তাঁদের কথামতো কাজ না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এসে টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো। অন্যের বাড়ি, সরকারি জায়গা দখল, রাস্তাঘাটে দোকান বসিয়ে অর্থবাণিজ্য, বস্তি, ট্রাক ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংকে আশ্রয়প্রশ্রয় দেওয়াসহ নানান সন্ত্রাসকাণ্ডের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক এমপিদের বিরুদ্ধে।
মোহাম্মদপুরের আতঙ্ক নানক : ঢাকা-১৩ আসন মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলানগর থানা এলাকার একাংশ নিয়ে গঠিত। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এমপি হন আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। সে সময় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। এ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার থেকে শুরু করে বরাদ্দসহ সব উন্নয়ন কাজে তাঁকে পার্সেন্টেজ দেওয়ার আলোচনা ছিল সর্বত্র। বরিশালের বাসিন্দা হলেও মোহাম্মদপুর-আদাবর-শেরেবাংলানগরে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেন তিনি। যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের দখল বাণিজ্য চলত নানকের হুকুমে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কোনো জায়গা খালি দেখলে সেখানে প্রথমে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট বানানো হতো। চারপাশ ঘেরাও করে রাখা হতো। এরপর হয় সামাজিক ক্লাব অথবা দলীয় কার্যালয়ের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখল নেওয়া হতো।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা ভোটে এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নানক। গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। বাহিনীর সদস্যদের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বানিয়ে বিভিন্ন পদে আসীন করেন তিনি। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প মাদকের আখড়ায় পরিণত করার জন্য নানককে দায়ী করেন স্থানীয়রা। এলাকার আতঙ্ক ছিলেন নানকের কথিত পালিত সন্তান মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব। নানকের হয়ে সব অপকর্ম করতেন রাজিব। নানকের আশীর্বাদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাসিনো ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মানুষের বাড়িঘর, জমি দখল ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলে এলাকায় ত্রাস কায়েম করেন রাজিব। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পাননি নানকের কারণে।
২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাতে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মোহাম্মদপুরের বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। নৈশভোজ শেষে তিনি গাড়িতে ওঠার সময় তাঁর ওপর হামলা হয়। পরে জানা যায়, হামলাকারীরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মী এবং নানকের অনুসারী।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হলেও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রভাব আর প্রতাপ দুটোই ছিল নানকের। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলি বাণিজ্য ও নানা ইস্যুতে লবিং-তদবিরে পার্সেন্টেজ আদায়ের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। যার প্রমাণ মেলে ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁর দাখিল করা হলফনামায়। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৫১ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দাখিল করেন। এর মধ্যে নানকের ১২ কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৭ এবং তাঁর স্ত্রীর ৬ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ৬২৪ টাকা। ২০০৮ সালে যেখানে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫১ টাকা। ২০২৪ সাল নাগাদ ১৮ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদ বাড়ে তাঁদের। হলফনামার বিশ্লেষণেও নানা চমক দেখিয়েছেন নানক দম্পতি। ২০০৮ সালে যেখানে নানকের বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে তাঁর আয় ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ টাকা দেখানো হয়। ২০০৮-এর হলফনামায় কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ২ একর ৬৫ শতাংশ জমির মালিকানা দেখান নানক। তখন অবশ্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আর কোনো স্থাপনার মালিকানা দেখাননি। ২০২৪-এর বর্ণনায় রাজধানীর উত্তরায় ছয় তলা ও মোহাম্মদপুরে আট তলা বাড়ি, কক্সবাজারে জমি, বরিশালে দুটি বাড়ি এবং সেখানে ভূসম্পত্তি ও মাছের খামার থাকার তথ্য দেন তিনি। এর বাইরে বহু সম্পদের তথ্য গোপন রাখার অভিযোগও রয়েছে নানকের বিরুদ্ধে। বরিশাল মহানগরের নবগ্রাম রোড এলাকায় রয়েছে নানক পরিবারের বিপুল ভূসম্পত্তি এবং প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স। যার উল্লেখ নেই তাঁর আয়কর রিটার্নে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বাবুগঞ্জে দোয়ারিকা সেতুসংলগ্ন ১০ একর জমির মালিকানার তথ্যও গোপন করা হয়েছে। বরিশালে গ্লোবাল ভিলেজ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা রয়েছে নানক পরিবারের। সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে বিপুল আয়তনের জমিসহ বরিশাল ও ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাট-জমি থাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে নানক দম্পতির বিরুদ্ধে। আর নানক এসবের মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগের শাসনামলে।
প্রকাশ্যে স্বল্পভাষী, ভিতরে ভয়ংকর আসাদুজ্জামান খান কামাল : নবম জাতীয় সংসদে ঢাকা-১১ আসনে (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শেরেবাংলানগরের আংশিক ও হাতিরঝিল থানা) নির্বাচিত হন আসাদুজ্জামান খান কামাল। আসন পুনর্বিন্যাসের পর ঢাকা-১২ আসন থেকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন তিনি। এমপি হওয়ার পর শিল্পাঞ্চল তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মাসোহারা নেওয়া শুরু করেন কামাল। নিয়োগ করেন এজেন্ট। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো। মাসে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হতো। গড়ে তোলা হয়েছিল মাদকের মাফিয়া সাম্রাজ্য। মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্থানীয় কমিশনার ও কয়েকজন শ্রমিকনেতার হাতে।
কামালের পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মকবুল হোসেন, ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি মনির তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাশেম গংয়ের নেতৃত্বে দোকান দখল, গাড়িপ্রতি চাঁদা আদায়, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পাইকারের আনাগোনা রয়েছে। পণ্য কেনা, পরিবহনে লোড-আনলোড করা, ভ্যানগাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুনতে হতো নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। এ ছাড়া পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্যও চাঁদা দিতে হতো। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, হকার লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ নেতাদের নিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে এবং কথা না শুনলে করা হতো নির্যাতন। এজন্য দলীয় ক্যাডার ও প্রশাসন ব্যবহার করতেন তিনি। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে হাজার কোটি টাকার মালিক হন আসাদুজ্জামান খান কামাল। নিয়োগ ও বদলিতে তিনি বস্তা ধরে ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করেছে কামালসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে।
নৌকায় উঠে বদলে যান মেনন : বিচারপতি আবদুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার। তাঁর ছেলে রাশেদ খান মেনন। কট্টর বাম রাজনীতিক মেনন তখন বাবার বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে প্রথম লাইমলাইটে আসেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেনন। সারা জীবন আদর্শিক পথে চলায় ১৯৭৯ সালে বরিশাল-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালেও তিনি এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৮ (মতিঝিল-শাহবাগ, রমনা, পল্টন) আসনে নিজস্ব প্রতীক হাতুড়ি ছেড়ে নৌকায় উঠে এমপি হন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে একই আসন থেকে নির্বাচিত হন। দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ তাঁকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীর নামকরা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর দুর্নীতির হাতেখড়িও মূলত এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই। উইলসের সভাপতি থাকাকালে অবৈধ পন্থায় ১২৮ জনকে শিক্ষকসহ স্কুলের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন মেনন। এসব নিয়োগে নেন কোটি কোটি টাকা। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানের ৪২ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের অর্থ। সাত বছরের দায়িত্ব পালনকালে এ এক বিদ্যালয় থেকেই তিনি প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। ভিকারুননিসা এবং আইডিয়ালেও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়েন তিনি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রী থাকাকালে এ দুটি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকা থেকে শত শত কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গোপন করেন নামে-বেনামে থাকা কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্যও। এ ছাড়া মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় নিয়মিত ক্যাসিনো চলত। ক্যাসিনো থেকে প্রতি রাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেতেন মেনন। একটি ক্লাবের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় আলোচনায় ছিল রাশেদ খান মেননের নাম।
দখলবাজদের টপার হাজি সেলিম : ঢাকায় আওয়ামী লীগের যে কজন এমপির বিরুদ্ধে দখল বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে টপার হচ্ছেন হাজি সেলিম। নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী হাজি মোহাম্মদ সেলিম বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।
নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে পুরান ঢাকার রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজি সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। না পেয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাঁকে মনোনয়ন দেয়। লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীর চর থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনি এলাকায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এমপি হন হাজি সেলিম। এরপর জমি ও বাড়ি দখলের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই সময় হাজি সেলিম নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন পাড়ামহল্লাগুলোয় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেন। বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে হাজি সেলিম নামমাত্র মূল্যে ওই জমির কাগজপত্র কিনে নিতেন। জোরপূর্বক উচ্ছেদের জন্য বিচার শেষে তিনি ঘরে বা দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। এজন্য এলাকায় ‘তালা হাজি’ খেতাব পেয়েছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনীঘাটে ওয়াসার পানির পাম্পের জমি দখল করে সেখানে পেট্রল পাম্প তৈরি করেন তিনি। সোয়ারীঘাটে নদীতীর দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ। নবাববাড়ী এলাকায় জগন্নাথ কলেজের (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রাবাস দখল করে সেখানে ‘গুলশান আরা প্লাজা’ নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। আরমানিটোলায় এক বৃদ্ধার সম্পত্তি দখল করে নির্মাণ করেন ‘এমটিসি টাওয়ার’। নলগোলায় ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি দখল করে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন হাজি সেলিম।
মোল্লাহর কথাই ছিল আইন : ঢাকা-১৬ আসনে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের টানা চারবারের এমপি। খাসজমি ও ব্যক্তিমালিকানায় থাকা পতিত জমির ওপর চোখ ছিল মোল্লাহর। হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির থেকে সাংবাদিকদের আবাসন প্রকল্পও রেহাই পায়নি তাঁর শকুনে দৃষ্টি থেকে।
কখনো নকল কাগজপত্র তৈরি করে, কখনো ক্যাডার পাঠিয়ে উচ্ছেদ করে প্লট ও জমি দখল করাই ছিল ইলিয়াস মোল্লাহর কাজ। দখল বাণিজ্যে মোল্লাহর জুড়ি ছিল না। মিরপুর-পল্লবীর বাসিন্দারা বলছেন, মোল্লাহর কথাই ছিল আইন। গত প্রায় ১৬ বছরে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। জায়গা দখল, রাস্তা-ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, লেগুনাস্ট্যান্ড, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলার জন্য তাঁর ছিল ১০০ সশস্ত্র ক্যাডার। এ বাহিনীকে এলাকা ভাগ করে দেওয়া ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে নির্বাচনি আসনটিতে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ২০টি বস্তি রয়েছে। প্রতিটি বস্তিতে ৫০০ থেকে ১ হাজারের বেশি ঘর রয়েছে। ঘর অনুযায়ী প্রতিটি থেকে ভাড়া আসত ৪ থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতিটি ঘরে আবার অবৈধ বিদুৎ ও গ্যাস সংযোগের জন্য আলাদাভাবে ভাড়া দিতে হতো। এ টাকার চার ভাগের তিন ভাগ চলে যেত ইলিয়াস মোল্লাহর পকেটে।
জানা গেছে, তুরাগ এলাকার ধৌর ও নলভো মৌজায় ইলিয়াস মোল্লাহ ৭০০ একর সরকারি খাসজমি দখল করে দোকানপাট, বস্তি ও অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করেছেন। সেগুলোর নিয়মিত ভাড়া তুলত তাঁর ক্যাডার বাহিনী।
ইলিয়াস মোল্লাহর আয়ের বড় একটি উৎস হলো দুয়ারীপাড়া। দুয়ারীপাড়ার ৪৭৩টি প্লট নিয়ে ওয়াকফ্ এস্টেট ও গৃহায়ন অধিদপ্তরের মধ্যে বিরোধ ছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে এটি নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। এখানকার জমি কোনো দলিল ছাড়াই কেনাবেচা হতো। যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। জমি থেকে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে বছরের পর বছর মোটা অঙ্কের চাঁদা নিতেন। এ ছাড়া এখানে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রতি মাসে বিল বাবদ এবং ভাড়ার নামে টাকা তুলতেন। সরকারি তহবিলে এ টাকা জমা হতো না, ঢুকত ইলিয়াস মোল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদের পকেটে।
ইলিয়াস মোল্লাহ বাড়ির বৈঠকখানায় বসাতেন সালিশ বৈঠক। আদালতের আদলে বিচার করতেন। তাঁর নির্দেশ বা বিচার মানতে গড়িমসি করলে নিজ হাতে মারধর করতেন। মামলা করে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দিতেন। আবার সালিশে কারও পক্ষে রায় দেওয়ার জন্য সহকারীদের মাধ্যমে অগ্রিম ঘুষও নিতেন।
দখলের গডফাদার তিন বছরের এমপি হাবিব হাসান : ২০২০ সালে মারা যান ঢাকা-১৮ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। উপনির্বাচনে এমপি হন ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান। তিনি এমপি হয়েই দখল বাণিজ্য নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। মার্কেট ও সরকারি জায়গা দখল, চাঁদাবাজি, বিমানবন্দর এলাকায় স্বর্ণ চোরাচালানে সহায়তাসহ অপকর্ম শুরু করেন। বনে যান মাফিয়া। চাঁদাবাজির টাকায় কানাডার বেগমপাড়ায় (টরন্টো থেকে প্রায় ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে স্কাব্রো এলাকায়) প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা দিয়ে ছেলে আবির হাসান তানি ও পুত্রবধূ শর্মিলা সিজানার নামে বাড়ি কিনেছেন হাবিব। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে পাচার করা অর্থ দিয়ে এ বাড়ি কেনা হয়। জানা যায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশে বাউনিয়া মৌজায় ১১০ বিঘা জমির ওপর হাবিব সিটি গড়ে তোলেন। এখানে অন্যের জমির ওপর জোর করে মাটি ভরাট করে হাবিব সিটির সীমানা বাড়ান তিনি।
হাবিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে অবৈধ কাঁচাবাজার ও পরিবহনে (লেগুনা/অটোরিকশা) চাঁদাবাজি। ডিশ-ইন্টারনেট অ্যান্টেনার আয়ে ভাগ। ফুটপাতে চাঁদা সংগ্রহ, ডোনেশনের নামে চাঁদাবাজি, দলে পদবাণিজ্য, উত্তরা সেক্টর কল্যাণ সমিতির নির্বাচন না দিয়ে কমিটি ঘোষণা। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ডেকোরেটরের কাজের টাকা না দেওয়া। হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফার্নিচার মার্কেট, স্কুল-কলেজে চাঁদাবাজি, জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ।
পরের সম্পত্তি দখল করে নিজের নামে সাইনবোর্ড লাগাতেন সাদেক খান : রাজধানীর মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, আদাবর, বছিলা, ঢাকা উদ্যান, বুদ্ধিজীবী, জাফরাবাদ, পুলপাড়, গদিঘর, রায়েরবাজার নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩ আসন। রাজধানীর এ বিশাল এলাকার বেশির ভাগেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খানের হাতে। নির্বাচনি এলাকায় তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। তাঁর মতের বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারওই ছিল না। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভয়ের রাজনীতি কায়েম করে এলাকায় বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, ফিলিং স্টেশন, কাঁচামালের আড়তসহ নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন তিনি। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপটে সরকারি খালের জমি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করে গড়ে তুলেছেন সাদেক ফিলিং স্টেশন, সাদেকনগর মডেল টাউন, সাদেক খান কৃষি মার্কেট, সাদেক খান হাঁস-মুরগির মার্কেট, সাদেক খান শুঁটকি মার্কেট, সাদেক খান ইট মার্কেট, সাদেক খান বালি মার্কেট, সাদেক খান বস্তিসহ একাধিক সম্পত্তি। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক রাস্তারও নামকরণ করেছেন তিনি।
সাবের লীগই ছিল সব : সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকা-৬ আসন থেকে ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আসন পুনর্বণ্টনের পর তিনি ২০০৮ সালে ঢাকা-৯ (খিলগাঁও-মুগদা-সবুজবাগ) থেকে টানা চারবার নির্বাচিত হন। সর্বশেষ বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এলাকায় পুরনো ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে পছন্দের লোকজন নিয়ে ‘সাবের লীগ’ নামে নতুন গ্রুপ গড়ে তোলেন। সাবের লীগের সদস্যরাই চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সরকারি খাস জায়গা দখল, মাদক বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি করতেন। এলাকায় কোথায়ও অ্যাপার্টমেন্ট ভবন করতে গেলেই দিতে হতো সাবের লীগকে টাকা। অথবা তাদের কাছ থেকে মালামাল কিনতে হতো। সাবের লীগের সদস্যদের চাঁদা না দিলে কোনো কাজ হতো না। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বাসস্ট্যান্ড, ফুডকোর্ট থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হতো। জানা গেছে, সাবের লীগের সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের মুগদা থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বাহার, বাসাবো থানার সাধারণ সম্পাদক লায়ন চিত্তরঞ্জন দাস, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ওয়াহিদ উদ্দিন মিল্টন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মামুনুর রশিদ শুভ্র, ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক নুরু, আওয়ামী লীগ নেতা সাদু এবং ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল মান্নান। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-৯ নির্বাচনি এলাকা সবচেয়ে মাদকের নিরাপদ স্থান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এসব জায়গায় সাবের লীগের সদস্যরা মাদক নিয়ন্ত্রণ করতেন। সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও, জাওল্লাপাড়া বাজার, ওহাব কলোনি, মাদারটেকের মিনারাগলি, মুগদা থানার মদিনাবাগ পানির পাম্প এলাকা, সিপাইবাগ নতুন রাস্তা, গ্রিল পট্টি, খিলগাঁও তালতলায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ও মাদক বিক্রি হতো। এর বড় অংশ চলে যেত সাবের লীগের সদস্যদের হাতে।
মানুষকে হয়রানি করাই ছিল কামাল আহমেদ মজুমদারের নেশা : ঢাকার কাফরুল, মিরপুর, কাজিপাড়া, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া পর্বতা, বড়বাগ, পীরেরবাগ এবং মণিপুর নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৫ আসন। এ আসন থেকে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কামাল আহমেদ মজুমদার। ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের এ সহসভাপতি ২০১৮-২০২৩ মেয়াদে ছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী। বারবার এমপি হওয়ার সুযোগে দখল, চাঁদাবাজি, মানুষকে হয়রানি করা ছিল নেশা। ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর অহংকারে তিনি অনেক মানুষকে করেছেন পথের ফকির। কেবল লোভের নেশায় তাঁর নিজের সার্কেলের অনেক মানুষকেও তিনি করেছেন নিঃস্ব। এলাকায় জায়গাজমি, স্কুল দখলসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। বর্তমানে হত্যাসহ একাধিক মামলায় কারাগারে রয়েছেন সাবেক এই প্রভাবশালী এমপি।
কামাল মজুমদারের হাত থেকে রেহাই পাননি বীর মুুক্তিযোদ্ধারা। ২০০৯ সালে মিরপুরের রূপনগরে মুক্তিযোদ্ধা সমিতি ৪১ শতক জায়গা কেনে ভবন নির্মাণের জন্য। ২০১৯ সালে সেই ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে কামাল মজুমদারের ভাই আনোয়ার মজুমদার একটি ভুয়া কমিটি বানিয়ে সংগঠন থেকে ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাদ দেন। সেখানে কামাল মজুমদারের আত্মীয় ও আজ্ঞাবহ লোকদের ২২টি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থদাতারা প্রতিকার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
কামাল মজুমদার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই তাঁর ওপর নেমে আসত চরম নির্যাতন। নিজস্ব ক্যাডার দিয়ে শায়েস্তা করার পাশাপাশি নিজের মালিকানাধীন একটি টেলিভিশন চ্যানেল দিয়ে প্রতিবাদকারীদের বিরাট সন্ত্রাসী বানানো হতো। এলাকায় কোনো টেন্ডার, ফুটপাতের দোকান, বাসস্ট্যান্ড, কিশোর গ্যাং লালনপালন করতেন কামাল মজুমদারের বাহিনীর লোকজন।
কামাল আহমেদ মজুমদার ঢাকার অদূরে সাভারের আড়ালিয়া বাজার এলাকায় অবৈধভাবে মানুষের জমি দখল করে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন। তবে সেই সাম্রাজ্য এখন তছনছ হওয়ার পথে। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জমির প্রকৃত মালিকরা এসে তাঁদের জমির দখল শুরু করেছেন। এর আগে শেখ হাসিনার পালানোর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রা কামাল মজুমদারের প্রকল্পের হরিণসহ অনেক গবাদি পশু ও মাছ লুট করে নেন। আশির দশকে সাভারের বরাকৈর মৌজায় একটি কৃষি প্রকল্প স্থাপন করেন কামাল মজুমদার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রকল্প এলাকার আশপাশের জমি একের পর এক দখল করতে থাকেন তিনি। এ ধারা চলমান থাকে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত।