একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আজহারুলের করা আপিল সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পূর্ববর্তী রায়ে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো যথাযথ পর্যালোচনা করা হয়নি। ফলে এতে ন্যায়বিচারের চরম বিপর্যয় ঘটেছে।
এর আগে এ মামলায় আপিলের ওপর শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য গতকালের দিন ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিলটি রায় ঘোষণার জন্য গতকালের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। বিচারপতিরা এজলাসে ওঠার পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
এই মামলায় আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। অন্য কোনো মামলা না থাকলে আজহারুলকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে রায়ে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন।
আদালতে আজহারুলের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম শুনানিতে অংশ নেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগের এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্য বিজয়ী ও মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। রায়ের পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেই শোকরানা নামাজ আদায় করেছেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।
সকালে রায় ঘোষণার পর দুপুরেই রায়ের সংক্ষিপ্ত অনুলিপিসহ আদেশ পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এরপর বিকালে আজহারুল ইসলামের মুক্তির আদেশ জারি করে ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের কারাবন্দি এই নেতা বর্তমানে কেরানীগঞ্জ কারাগারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকে আজ সকালেই মুক্তি পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
আপিল বিভাগের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছে, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে আপিল বিভাগ মনে করে, আপিলকারীরকে (আজহারুল ইসলামকে) দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনের মৌলিক নীতিগুলো স্পষ্টভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে এতে ন্যায়বিচারের চরম বিপর্যয় ঘটেছে। শুধু তাই না, আপিল বিভাগ স্বীকার করছে যে আপিলকারীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে ন্যায্যতার মান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে পূর্বের আপিল বিভাগ।’ এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আদেশে আরও বলা হয়েছে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তৃত প্রেক্ষাপট এবং এই মামলার অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশনের দুর্বলতাগুলো যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীর ওপর (ট্রাইব্যুনালের) দণ্ডাদেশ বহাল রাখা সম্ভব নয়।’
রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে : শিশির মনির- জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্য বিজয়ী ও মিথ্যা পরাভূত হয়েছে। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জামায়াত ও বিএনপির ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অন্ততপক্ষে পাঁচজন কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ টি এম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাই। আমরা এটাও মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি, এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।’
আদালত প্রাঙ্গণেই শোকরানা নামাজ : রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনেই দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেছেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। নামাজের পর সাংবাদিকদের কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করেন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।