রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে তাঁর দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবে সেটা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক।’ প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য সুচিন্তিত, দিকনির্দেশনামূলক এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত। এমন একসময় তিনি প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ডেকে বৈঠক করলেন, যখন দেশজুড়ে চলছে নানা রকম অস্থিরতা। অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত মানুষ। সারা দেশের মানুষ একটি নির্বাচনের জন্য যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তখন বিভিন্নভাবে নানা জায়গায়, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলোয় অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পিত প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে-এসব ঘটনা কি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অংশ? আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত না হতে পারে, সেজন্যই কি দেশজুড়ে পরিস্থিতি অশান্ত করা হচ্ছে?
শুক্রবার গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সংঘর্ষ ঘটে। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে গণঅধিকার পরিষদের একটি মিছিল দলটির কার্যালয় ভাঙচুরের চেষ্টা করে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। একপর্যায়ে সেখানে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই পুলিশের বলপ্রয়োগ সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরনের বলপ্রয়োগ পতিত স্বৈরাচারের কাজের প্রতিফলন। কোন পরিস্থিতিতে, কেন শুক্রবার এ ঘটনা ঘটেছে, তা অবশ্যই সরকার খতিয়ে দেখবে। ইতোমধ্যে সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিশ্চয়ই এ তদন্তে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এ ঘটনা কেন্দ্র করে কিছু কিছু অতি উৎসাহী মহল বাংলাদেশের শান্তিশৃঙ্খলার এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য শুধু নির্বাচনের পথই দুরূহ করবে না, বরং এটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলবে।
আমরা জানি এক বছর ধরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কি নিরলস পরিশ্রম করে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই এখন পর্যন্ত মানুষ ন্যূনতম শান্তিতে আছে। তারা ব্যারাক থেকে এসে এক বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশে মব, বিশৃঙ্খলা, সুযোগসন্ধানীদের নানানরকম লুটপাট এবং অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো সামাল দিতে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন পল্টন এলাকায় কী ঘটেছিল তা নিশ্চয়ই তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ হবে। কিন্তু এর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকে জড়িয়ে যেসব গুজব, মিথ্যাচার এবং উসকানিমূলক বক্তব্য তৈরি করা হচ্ছে, তা থেকে বিরত থাকতে হবে সব পক্ষকে, এখনই। আগাম মন্তব্য করে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক একটি বাহিনী সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করা উচিত নয়। এ ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনী পুলিশকে সহযোগিতা করেছে মাত্র। সশস্ত্র বাহিনীর মাঠের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে যা করেছেন তা যৌক্তিক ছিল কি না সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে, কিন্তু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সঙ্গে পুরো সশস্ত্র বাহিনীকে জড়ানো কখনোই যুক্তিবাদী চিন্তার ফসল নয়। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য যারা করছেন, তারা নির্বাচন বানচাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কি না বিবেচনার দাবি রাখে।
শুক্রবার পল্টনের ঘটনার আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নানাভাবে উত্তপ্ত এবং সহিংস হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবিতে শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন। সামনের দিকে বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। শনিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা এবং সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নেয়। গ্রামবাসীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহিংসতা পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত করে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে বাধ্য হন। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়তেও একই ধরনের সহিংসতা ঘটেছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহিংস উত্তেজনার খবর পাওয়া গেছে। ডাকসু নির্বাচন সামনে। এ নির্বাচন ঘিরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তাপ-উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সহিংসতার আগুনে পুড়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
রাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে ইতোমধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটুকু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে শান্তিপূর্ণ আবহ তৈরি করা দরকার, যেন দেশজুড়ে ভোটের একটা পরিবেশ তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বিঘ্নে জনগণের কাছে যেতে পারে। ভোটের ব্যাপারে প্রচার করতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার পরপরই ক্যাম্পাসগুলো এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অশান্তি ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিগুলো কাকতালীয় নাকি এর পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট ইন্ধন রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ আমরা লক্ষ করেছি ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অর্থাৎ রোজার আগে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণার পর অধিকাংশ মানুষ একে স্বাগত জানালেও একটি মহল এ বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়নি। তারা নির্বাচন পেছানোর জন্য নানানরকম অজুহাত এবং ইস্যু সামনে আনতে চাইছে। কেউ কেউ অযাচিতভাবে পিআর ইস্যু, কেউ গণপরিষদ নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় এনে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে। অন্যদিকে লক্ষণীয় জুলাই সনদ আগস্টে চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। সব পক্ষের স্বাক্ষর নিয়ে এটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। সেই জুলাই সনদ এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না। জুলাই সনদ ঝুলিয়ে রেখে কোনো পক্ষকে নির্বাচন বানচালের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কি না, এ নিয়েও বিভিন্ন মহল আলোচনা করছে। কারণ এনসিপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। তাদের মতামত পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ নিয়ে কেন এখন ঐকমত্য কমিশন কোনো কিছু করছে না, তা ভেবে দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ এখন একটি সংকটময় পরিস্থিতিতে। একদিকে মবসন্ত্রাস, চাঁদাবাজি; অন্যদিকে হতোদ্যম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একমাত্র সশস্ত্র বাহিনীর ওপর ভর করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধিকিধিকি প্রদীপের মতো জ্বলছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে গণতন্ত্র উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র একটি নির্বাচিত সরকার এসে যদি হাল ধরে তা হলেই এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে নানা রকম বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে দ্রুত জনগণের ক্ষমতায়ন জরুরি। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে এ অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে। বাংলাদেশ একটি রণভূমিতে পরিণত হবে। তা নিশ্চয়ই আমরা কেউ চাই না। আর এ কারণেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপলব্ধি যথার্থ ও সঠিক। তিনি যে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তা রবিবারের বৈঠকের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো। তিনি বুঝেছেন বাংলাদেশ ঘিরে এখন নানা রকম ষড়যন্ত্র চলছে। পতিত ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার জন্য দেশে যত গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা দরকার সবই করবে। সামনের দিনগুলোয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কেন্দ্র করে তারা স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করবে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করছি সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। যারা প্রধান উপদেষ্টাকে দায়িত্বে বসিয়েছেন তারা নিশ্চয় জানেন প্রধান উপদেষ্টা দেশের কল্যাণ চান, মঙ্গল চান এবং জনগণের ভালো চান। এজন্যই তিনি কঠিন সময়ে দেশের হাল ধরেছেন। কাজেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া বা নির্বাচনের কোনো বিকল্প চিন্তা করা যে জাতির জন্য বিপজ্জনক, তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রবিবার (৩১ আগস্ট) প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। আশা করি যারা যে কারণেই দেশজুড়ে অস্থিরতা, মবসন্ত্রাস ইত্যাদি সৃষ্টি করুক না কেন, তারা দেশকে ভালোবাসবেন, দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হবেন। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য যে-যার অবস্থান থেকে কাজ করবেন। একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ফেব্রুয়ারিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনই দেশকে পথ দেখাবে এবং একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে যাত্রা হবে।