হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভিতরে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্যের কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। শনিবার রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার ১৯ ঘণ্টা পর গতকাল বিকালেও ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে বাতাসে ছড়িয়েছে পোড়া গন্ধ। যদিও বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে আগুন নির্বাপণ হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস।
সংস্থাটি জানিয়েছে, দীর্ঘসময় ধরে আগুন স্থায়ী হওয়ায় কার্গো কমপ্লেক্স ভবনটির দেয়াল ও কলামসহ বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি নির্ণয়ের পর ভবনটি চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পোড়া ভবনটির সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ভিড় দেখা গেছে।
ফায়ার সার্ভিসের গাফিলতিতে দেরিতে উদ্ধার কাজ শুরু এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসকে ভিতরে প্রবেশে বাধা দিয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ করেন প্রত্যক্ষদর্শী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। এই অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। কার্গো কমপ্লেক্সে ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম না রাখা, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম না থাকার পেছনে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্স ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভিতরে কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি ইউনিট।
কুরিয়ার অফিসের বিপরীত পাশের ফুটপাতে জড়ো হন ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থেকে শুরু করে উৎসুক জনতা। ৮ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেন বেশির ভাগ গণমাধ্যমকর্মী। ঢাকা কাস্টমস হাউস ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ডাকলে সেখানে শুধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা অবস্থান করেন। আমদানি কোম্পানির স্টাফরা ধোঁয়া দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখনো আগুন নেভেনি। এত সময় লাগার কারণ কী? এত ইউনিট এসে কী লাভ হলো? ভিতরে তো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছেছি। কোথাও কোনো বাধা বা বিলম্ব হয়নি। বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার টিম ও আমাদের ফায়ার সার্ভিস পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করে। এখানে কোনো নিয়মবিরোধী কিছু হয়নি। তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থলে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম ছিল না। কার্গো ভিলেজের অংশটুকুতে ছোট ছোট ভাগ করা এবং স্টিলের স্ট্রাকচার দিয়ে বানানো হয়েছে। চলাচলের জায়গাও খুব সরু। ফলে এই স্টিল কেটে ঢোকাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
এগুলো দিয়ে এখনো তাপ অপসারণ হচ্ছে। যার কারণে ধোঁয়া থামছে না। দীর্ঘক্ষণ আগুন জ্বলতে থাকায় ভবনের দেয়াল ও কলামের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা গেছে। ভবন কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এটির ঝুঁকি পরীক্ষার পর চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া। অগ্নিকান্ডের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত রিফলাইন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লজিস্টিক্স কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ফারহানা কামাল বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির মালামাল আমদানি করতে আমরা ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। মালিকরা ওই পণ্য না পেলে আমাদের টাকা দেয় না। যেহেতু পণ্য পুড়ে গেছে, আমরা আর ওই টাকা পাব না। কমা ক্রিয়েশনের সিঅ্যান্ডএফের কর্মী মুজিবর রহমান বলেন, মালামাল খালাসের কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমাদের কোম্পানি ও পণ্যের মালিকরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছে এর প্রভাব আমাদের ওপরও পড়বে। অনেকেই বেকার হবে। বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার বলেন, সুনির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকায় এবং কেউ অভিযোগ করতে না আসায় মামলা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে ব্যবসায়ীরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে আসছেন। এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি জিডি নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত আরও ব্যবসায়ীরা আসছেন। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তার জন্য ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কোর কমিটি : স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সুপারিশসহ ৫ নভেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করবে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলনকক্ষে অগ্নিনির্বাপণ নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা বীরপ্রতীক ফারুক-ই আজম।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীনসহ কমিটির সদস্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, শনিবার দুপুর ২টার দিকে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় ফ্লাইট ওঠানামা। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিটসহ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা। সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে এবং রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর পুনরায় চালু হয়।
ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, অর্থ মন্ত্রণালয়।