ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরপর দুটি ‘কেপিআই’ (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ‘কেপিআই’ ছাড়াও বাণিজ্যিক ভবন, মার্কেট ও শিল্পকারখানায় একের পর এক অগ্নিকান্ড মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে সরকার। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অঘটনের শঙ্কা উঠে আসায় রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। গতকাল বিকালে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জরুরি বৈঠকে বসেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। অন্যদিকে গত শনিবার রাতেই পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের সব পুলিশ ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পাশাপাশি বিমানবন্দর, সচিবালয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, অন্যান্য ‘কেপিআই’ এলাকাগুলোতে টহল ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। জানা গেছে, শনিবার রাত থেকেই শুরু হয় এ সতর্ক অভিযান। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো মৌখিক নির্দেশে জানানো হয়, কোনো ধরনের নাশকতা, নৈরাজ্য বা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত টহল, চেকপোস্ট স্থাপন ও সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বাহারুল আলম জানান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সারা বছরই নিরাপত্তা জোরদারে নির্দেশনা থাকে। কেপিআই এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে।
খুলনা রেঞ্জ পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সদর দপ্তরের নির্দেশ আসার পর রাতেই সব থানায় সতর্কতা জারি করা হয়। রেলস্টেশন, জ্বালানি গুদাম, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর এলাকায় বিশেষ টহল চলছে। সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে মোট ৫৮৭টি কেপিআই রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন, সচিবালয়, বিমানবন্দর, কারাগার, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যোগাযোগ অবকাঠামো, রেলওয়ে স্থাপনা ও টেলিযোগাযোগ কেন্দ্রগুলো রয়েছে। এসব স্থাপনায় নিয়মিত নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ, র্যাব ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সদস্যরা থাকলেও দুই দিন ধরে এদের পাশাপাশি অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি কেপিআই এলাকায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারদের সশরীরে নিরাপত্তা তদারকি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে আইন ও বিধি অনুযায়ী আমাদের ডিএসবিসহ সব ইউনিট সব সময় তৎপর।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, রাজধানীর কেপিআই এলাকাগুলোর নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে শাহবাগ, আগারগাঁও, মতিঝিল, বিমানবন্দর ও কাকরাইল এলাকায় টহল দল বাড়ানো হয়েছে। রাতের বেলায় মোবাইল টিম ও ডিবি পুলিশ যৌথভাবে টহল দিচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিদ্যমান কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগের কথা বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা মান, অগ্নিনির্বাপণ প্রস্তুতি ও মনিটরিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা উচিত। একই সঙ্গে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম, সিসিটিভি আপগ্রেড ও জরুরি প্রতিক্রিয়া ইউনিটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালায় যা রয়েছে : নীতিমালা অনুযায়ী, কেপিআই স্থাপনাগুলোয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালায় দুই শ্রেণির নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে বলা হয়েছে, ‘কেপিআইয়ের ২০ মিটারের ভিতরে ভূগর্ভস্থ পয়োনিষ্কাশন লাইন কিংবা যে কোনো সুড়ঙ্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে কেপিআইডিসির মতামত বা ছাড়পত্র নিতে হবে। কেপিআইয়ের চতুর্দিকে অবস্থিত যেসব স্থাপনা থেকে গোপনে ছবি তোলা যায় বা আগ্নেয়াস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুর আওতায় পড়ে, সেসব স্থাপনায় সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। কেপিআই গেটগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং এর উচ্চতা সীমানাপ্রাচীরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। টহলরত কর্মকর্তারা গেটের বাইরের অংশে যেন সার্বক্ষণিক দৃষ্টিসীমা রাখতে পারেন, তার জন্য পর্যাপ্ত ফাঁক রাখতে হবে।
প্রথম শ্রেণিতে তিন ধরনের (ক, খ ও গ) নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির নিরাপত্তায় নানা ধরনের নিরাপত্তা বলয়ের কথা বলা হয়েছে। এসব নিরাপত্তায় কার কী দায়িত্ব, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করা আছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুনের পরদিনই মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়। বলা হয়, দেশের প্রতিটি জেলা ও থানা পর্যায়ে কেপিআই এলাকার নিরাপত্তা তদারকিতে বিশেষ অফিসার নিয়োগ দিতে।
সতর্ক সরকার : শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সরকার তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করছে। মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যদি এসব ঘটনার পেছনে কোনো নাশকতা বা সংগঠিত অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বিঘিœত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
তদন্তে একাধিক সংস্থা : অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো তদন্তে একাধিক সংস্থা কাজ করছে বলে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিস, সিআইডি, ডিবি ও নৌ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি অগ্নিকান্ডের ধরন অনেকটাই একই, যা কাকতালীয় নয় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, একই সময়ের মধ্যে এতগুলো বড় অগ্নিকান্ড নিছক দুর্ঘটনা হতে পারে না। প্রতিটি ঘটনায় যদি উদ্দেশ্য থাকে আতঙ্ক সৃষ্টি বা প্রশাসনকে ব্যস্ত রাখা, তাহলে সেটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্রও হতে পারে।