৮ মে, ২০২২ ১৩:৪৯

জানতে হবে থ্যালাসেমিয়াকে

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

জানতে হবে থ্যালাসেমিয়াকে

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

প্রতিবছরের মতো এ বছরও ৮ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য “জানুন, জানান, যত্ন নিন”। সচেতনতা আর সঠিক যত্নের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী থ্যালাসেমিয়ার ভযাবহতা রুখে দেওয়া সম্ভব-এটাই এবারের মূল বক্তব্য। 

থ্যালাসেমিয়া একধরনের বংশগত রক্তরোগ। এটি জিনবাহিত অসুখ। মানুষের দেহ কোষে অবস্থিত জিনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। 

আমাদের রক্তের লোহিতকণিকায় হিমোগ্লোবিন থাকে। এটি একটি বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থ। শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা এর প্রধান কাজ। জিনগত কারণে এই হিমোগ্লোবিনের গঠনে বা তৈরি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দিলে এর উৎপাদন ব্যাহত হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকার উৎপাদনের গতি হ্রাস পায়, আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় শরীরে রক্তস্বল্পতা এবং জন্ডিস দেখা দেয়। সাথে দেখা দেয় আরো কিছু উপসর্গ। এটাই হলো থ্যালাসেমিয়া।

থ্যালাসেমিয়া অনেক রকমের আছে। সহজ করে বলা যায়, থ্যালাসেমিয়া প্রধাণত দুই প্রকার-আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এর উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। 

বিটা থ্যালাসেমিয়া দুই রকমের হতে পারে। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। অপরটি থ্যালাসেমিয়া মেজর।
শরীরের যেকোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য দুটি জিন দায়ী। এর একটা আসে বাবা থেকে, আরেকটা মা থেকে। যদি হিমোগ্লোবিন তৈরির একটি জিন ভালো এবং একটি মন্দ থাকে তাহলে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে (১০-৫০ শতাংশ) কম তৈরি হয়। এ ধরনের রোগীকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইট বলে। থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট মূলত রোগটির বাহক বা ক্যারিয়ার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারাজীবন এই রোগ বহন করে চলে। অল্পকিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। যাদের দুটি জিনই মন্দ রোগের লক্ষণগুলো শিশুকালেই প্রকাশ পায় এবং সহজেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এদের থ্যালাসেমিয়া মেজর বা বিশেষ ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমেডিয়া বলে। বাবা ও মা উভয়ে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার  হলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। ক্যারিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ ভাগ।
এছাড়া হিমোগ্লোবিনের গঠন পদ্ধতিতে সমস্যা থাকতে পারে। এদের Hb-E, HbC, Hb-D ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এদের সংমিশ্রণও হতে পারে। বাংলাদেশে হিমোগ্লোবিন ‘ই’ এবং হিমোগ্লোবিন বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটের প্রকোপ বেশি।
 
ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, শ্বাসকষ্ট, ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি হলো থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃতও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থি পাতলা হয়ে যেতে থাকে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়। নাকের হাড় দেবে যায়। মুখের গড়ন হয় চীনাদের মতো। একে বলে ‘মংগোলয়েড ফেস’। শরীরের বৃদ্ধি কমে যায়। আস্তে আস্তে দেখা দেয় বিশেষ কিছু জটিলতা।

রোগীকে ঘনঘন রক্ত দিতে হয় বলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই আয়রন জমা হয় হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে। এই পর্যায়টি মারাত্মক। দেখা যায়, অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার কারেণে অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী নানাবিধ শারীরিক জটিলতার কারণে মারাও যেতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া শনাক্ত করার সবচেয়ে চালু পদ্ধতিটি হলো রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা। রক্তের রুটিন পরীক্ষা (সিবিসি) থেকে থ্যালাসেমিয়ার সম্ভাবনা আঁচ করা যায়। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করেও এই রোগ ধরা যায়।

রক্ত পরিসঞ্চালনই থ্যালাসেমিয়ার মূল চিকিৎসা। আয়রন বেড়ে গেলে আয়রন চিলেশনের ওষুধ দিয়ে তা কমাতে হয়। প্লীহা অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে প্লীহা কেটে ফেলতে হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হার কিছুটা কমে আসে। মূলত অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হলো এর স্থায়ী চিকিৎসা। জিন থেরাপিও এই রোগের আরেকটি উন্নত চিকিৎসা। কিন্তু এই চিকিৎসগুলো সাধারণের নাগালের বাইরে। আমোদের দেশে এর সুযোগ এখনো সীমিত। তবে ক্রমশ বাড়ছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরনের বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি দশ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। প্রতিবছর নতুন করে সাত হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হচ্ছে।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা খুব জরুরি। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া অনেকখানি কমানো যেতে পারে। দুজন ক্যারিয়ারের মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া কমানো সম্ভব। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে।  ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে বাচ্চা পেটে আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করতে হবে। একে বলে এন্টিন্যাটাল চেক আপ। এন্টিনৗাটাল চেক আপে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যাবরশন করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ উপায়ে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ কমানো গেছে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। সরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, গণমাধ্যম সব দিক থেকেই এই সচেতনতা তৈরি করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।  

লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।

সর্বশেষ খবর