২২ মে, ২০২৪ ১২:১৬

হার্ট ফেইলুর নিয়ে কিছু কথা...

ডা. এম. শমশের আলী

হার্ট ফেইলুর নিয়ে কিছু কথা...

প্রতীকী ছবি

মানবদেহে হার্ট এমন একটি অঙ্গ যা সংকোচনের মাধ্যমে রক্ত পাম্প করে, সারা শরীরে রক্তের মাধ্যমে খাদ্য বস্তুর নির্যাস (রসদ) ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে থাকে। সবাই জানে, অক্সিজেন ও রসদ ছাড়া শরীরের কোনো অঙ্গ বা তাতে থাকা কোষের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। অর্থাৎ তার কর্ম তৎপরতা চালাতে পারে না। সোজা-সাপটাভাবে বলতে গেলে বলা যায় রক্তপ্রবাহ ছাড়া ব্রেইন তার কাজ করতে অসমর্থ হয়, কিডনি তার কাজ মানে রক্ত পরিষ্কার করা বন্ধ করে দেয় লিভার তার দায়িত্ব পিত্ত তৈরি, বিষাক্ত বস্তু অকার্যকর করা বন্ধ করে দেয়। একইভাবে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ তার কার্যক্রম হারায় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সুতরাং এটা বলাই যেতে পারে, হার্টের কার্যকারিতার উপরে সারা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরাসরি জড়িত।

হার্ট যখন তার দায়িত্ব মানে রক্ত পাম্প করে সারা শরীরে রসদ ও অক্সিজেন প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তখন এই অবস্থাকে হার্ট ফেইলুর বলা হয়। মানব শরীরে অক্সিজেন ও বসদের চাহিদা সময়ে সময়ে কম বেশি হয়ে থাকে। যেমন একজন ব্যক্তি বিশ্রাম নিচ্ছিল বা বসে টেলিভিশন দেখছে তখন তার শরীরে অক্সিজেন ও রসদের চাহিদা সর্বনিম্ন পরিমাণে হয়ে থাকে, তবে ব্যক্তি যদি উঠে হাঁটা শুরু করেন তখন তার চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পায় এ ক্ষেত্রে বিশ্রামকালীন সময়ের চেয়ে চাহিদা ২ থেকে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এই ব্যক্তি যদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন তখন তার চাহিদা ৬ থেকে ৭ গুণ বৃদ্ধি পায় কিন্তু সে যদি দৌড়াতে শুরু করেন তবে তার চাহিদা ১০ গুণ বা তারও অধিক পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এ বিবেচনায় হার্ট রক্ত পাম্প করে শারীরিক চাহিদা মেটাতে শরীরের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি রক্ত পাম্প করতে হচ্ছে। একটি সুস্থ হার্ট অনায়াসে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা রাখে। হার্ট যে কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে সে শারীরিক প্রয়োজনমাফিক রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। ঠিক তখনই পরিশ্রমকালীন মানে দৌড়াতে, সিঁড়িতে উপরে উঠতে বা অন্য কোনো ভারী কাজ করতে গেলে ব্যক্তি হাঁপিয়ে উঠেন এবং কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিশ্রামকালীন মানে শুয়ে বসে বা হালকা কাজ করার সময়ে কোনোরূপ অসুবিধায় পতিত হন না মানে একদম সুস্থ থাকেন। তিনি যদিও হার্ট ফেইলুরে ভুগছেন তা বুঝতে পারেন না, অনেকে তা মানতে চান না। তারা ভাবে এটা এক ধরনের সাময়িক অবস্থা যা বিশ্রাম নিলে বা কাজ বন্ধ করে দিলে এমনিতে সেরে যায়। আবার অনেক ব্যক্তি এটাকে বয়সজনিত অপারগতা ভেবে সুস্থবোধ করে থাকেন। হার্টের যে কোনো ধরনের অসুস্থতা চরম পরিণতি হিসেবে হার্ট ফেইলুর হয়ে থাকে। তবে হার্ট ফেইলুরের বিভিন্ন পর্যায় থাকে যেমন প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং চরম পর্যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী অধিক পরিশ্রম হার্টের বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হবেন যেমন দ্রুত হাঁটতে গেলে বা দৌড়াতে গেলে বুক চেপে আসা, বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, হাঁপিয়ে উঠা বা বুক ধড়ফড়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে অল্প পরিশ্রমে বা একটু বেশি হাঁটাহাঁটিতে উপরে উল্লিখিত উপসর্গে আক্রান্ত হবেন এবং চরম পর্যায়ে ব্যক্তি খুব অল্প পরিশ্রমে বা বিশ্রামকালীনও উপসর্গগুলোতে আক্রান্ত হবেন এবং ওইসব উপসর্গ দেখা দিবে যেমন, পেটে অত্যধিক গ্যাস উৎপন্ন হওয়া, পেট ফেঁপে যাওয়া, প্রশ্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া মানে হাত-পা ও মুখে পানি জমে ফুলে যাওয়া, বদহজম বা ঘন ঘন পেট খারাপ হওয়া, ঘন ঘন সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি আরও অনেক ধরনের সমস্যায় মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে।

আগেই আলোচনা করেছি, হার্টের সব ধরনের অসুস্থতার ফলশ্রুতিতে এবং অন্যান্য আরও অনেক শারীরিক অসুস্থতার কারণে মানুষ হার্ট ফেইলুরে পতিত হয়ে থাকে যেমন হার্ট ব্লক, হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিওমাইওপ্যাথি, মাইওকার্ডাইটিস, পেরিকার্ডাইটিস, হার্ট ভাল্বের সমস্যা, রিওমের্টিক হার্ট ডিজিজ, জন্মগত হার্টের সমস্যা, রিং বাইপাস। পরবর্তীকালে এছাড়াও শারীরিক অন্যান্য অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা হাইপ্রেসার, থাইরয়েড হরমোনজনিত অসুস্থতা, রক্তশূন্যতা, কিডনি ফেইলুর, লিভার ফেইলুর, ফুসফুসে প্রদাহ, ব্রংকাইটিস, ইনফাইসেমা, ক্রনিক লাংগ ডিজিজ অ্যাসমা, ক্যানসার, ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে কেমোথেরাপি ও রেডিও থেরাপি গ্রহণ করা ইত্যাদি। তবে যে কারণেই হার্ট ফেইলুর হোক না কেন রোগী একই ধরনের হার্ট ফেইলুরের লক্ষণে আক্রান্ত হবেন এবং তার সঙ্গে উল্লিখিত শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণও বিরাজমান থাকবে। হার্ট ফেইলুর সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে যেমন একুইট হার্ট ফেইলুর যাতে রোগী তাৎক্ষণিকভাবে চরম হার্ট ফেইলুরে পতিত হয় এবং দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাক, হৃদস্পন্দনজনিত সমস্যা এ অস্বাভাবিক মাত্রায় উচ্চরক্তচাপে বা হাইপ্রেসার থেকে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর হার অনেক বেশি এবং তাৎক্ষণিক হয়ে থাকে। অন্যটি হলো ক্রনিক হার্ট ফেইলুর যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা। তবে চরম পর্যায়ে ক্রনিক হার্টফেইলুর একিউট  হার্ট ফেইলুরে পরিণত হয়ে খুব সহজেই রোগীর মৃত্যু ঘটাতে পারে। হার্ট ফেইলুর থেকে বাঁচার উত্তম ব্যবস্থা হলো উপরে উল্লিখিত কারণগুলোকে প্রতিহত এবং সুচিকিৎসা গ্রহণ। একবার হার্ট ফেইলুরের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে দৃঢ়তার সঙ্গে হার্ট স্পেশালিস্টের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করা।

লেখক: হার্ট স্পেশালিস্ট পরিচালক ও চিফ কনসালটেন্ট, শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর