২৪ মে, ২০২৪ ১৫:০৮

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কিছু কথা

অধ্যাপক ব্রিগে. জেনা. (অব.) ডা. মো. আজিজুল ইসলাম

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কিছু কথা

১। ২৪ মে বিশ্ব সিজোফ্রেনিয়া সচেতনা দিবস। এ বছর বিষয়ের প্রতিপাদ্য হলো সামাজিক সহানুভূতির শক্তিকে উজ্জীবিত করি।

২। সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে ভাবনার বিষয়টি ব্যাপক ও বিস্তৃত। সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে লিখতে বসলেই প্রথমেই ভেসে উঠে স্মার্ট বাংলাদেশের আনস্মার্ট চিত্র। সিজোফ্রেনিয়া নামক মনের রোগটিকে চিন্থিত করা হয়, জীনে ধরা, পরীতে ধরা, ভূতে ধরা, উপরি লাগা, বাতাস লাগা, শয়তানে ভর করা হিসেবে। আর চিকিৎসা হয় অমানবিক ভাবে (লাঠিপেটা, চুলকেটে দেওয়া, গরম তেলে স্যাক দেওয়া)। একজন মানসিক রোগীকে এভাবেই হতে হয় নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, অপমানিত। সমাজ তাকে একা করে ফেলে, পৃথক করে ফেলে, তাকে অবহেলা করে, চাকরিচ্যুত করে, চিকিৎসা তো করায়ই না। একটি কর্মক্ষম স্বাভাবিক মানুষকে করে ফেলে অসহায় কর্মহীন।

৩। অথচ সিজোফ্রেনিয়া নামক রোগটির আছে বৈজ্ঞানিক কারণ, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর তেমনি আছে সঠিক ও যথাযথ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা। স্মার্ট বাংলাদেশে সিজোফ্রেনিয়ার আছে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক স্মার্ট চিকিৎসা। সিজোফ্রেনিয়া কিছুটা জটিল মানসিক রোগ। এটা সাইকোটিক রোগ যাতে রোগীর অর্ন্তদৃষ্টি থাকে না, বাস্তবতা বোধ কমে যায় বা রহিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগী নিজে বুঝতে পারে না, সে একটি মানসিক রোগে ভুগছে।

৪। টাইপ ওয়ান সিজোফ্রেনিয়া চেনা সহজ কারণ এতে রোগীর আচার/আচরণ, কথাবার্তা, চাল-চলনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। অনেক সময় অস্বাভাবিক ব্যবহার করে, রাগারাগি করে উশৃঙ্খল আচরণ করতে পারে। কথাবার্তা অনেক বেশি, অর্থহীন, অহেতুক হয়। এই প্রকার রোগে ডিলিউসান ও হ্যালুসিনেসান থাকে। ডিলিউসান হলো ভ্রান্ত বিশ্বাস (যেমন, লোকজন তাকে অনুসরণ করে, অন্যরা তার ক্ষতি করবে, ব্ল্যাক ম্যাজিক করে। ক্যামেরা/ইন্টারনেটে তার কার্য্যবিধি মনিটর করে, মাথায় কিছু বসিয়ে দিয়ে তাকে কনট্রোল করা হয় ইত্যাদি। হ্যালুসিনেসান হলো অলীক প্রত্যক্ষণ (কেউ কানে কানে কথা বলে, তার কাজে কর্মের কমেন্ট করে, তাকে আদেশ/নির্দেশ দেয় যা সে শুনে)। ডিলিউসান বা হ্যালুসিনেসান বাস্তবিক ও সঠিক নয় কিন্তু রোগী ভাবে তা সঠিক ও সত্য। টাইপ ২ সিজোফ্রেনিয়া চিনতে অনেক সময় চলে যায়। রোগী একাকি, নির্ঝঞ্জাট, নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে, শান্ত চুপচাপ থাকে, কারো সাথে মিশে না, বন্ধু বান্ধব থাকে না, কাজ কর্মে উদ্দীপনা থাকে না, হতাশ/বিঘাদগ্রস্থ থাকে, কথা কম বলে, কোন সুস্থ স্বাভাবিক পারিবারিক/সামাজিক জীবন নির্বাহ করে না। এসবের সাথে সাথে তার ডিলিউসান বা হ্যালুসিনেসান থাকতে পারে।

৫। লক্ষণ/চিহ্ন যেমনই হোক না কেন, এই রোগের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ স্পষ্ট ও জ্ঞাত। ইনসুলিন নামক হরমোনের স্বল্পতার জন্য যেমন ডায়রেটিস হয় তেমনি ভাবে ব্রেইনের কিছু কেমিক্যালস (নিউরো ট্রান্সমিটার) যেমন ডোপামিন, সেরোটনিন, নরইপিনিপরিন ইত্যাদির ব্যতয়ের জন্য এই রোগ হয়ে থাকে। সুতরাং এই রোগটি চিহ্নিত করে নিউরো ট্রান্সমিটারের ব্যতয় সংশোধন করেই সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যত তাড়াতাড়ি এই রোগের চিকিৎসা করা যায় তত তাড়াতাড়ি এই রোগ নিরাময় করা সম্ভব।

৬। সিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে আমাদের যা জানা খুবই জরুরি:
ক) সিজোফ্রেনিয়া রোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসা এদেশেই হয় এবং তা অন্য যে কোন দেশের চেয়ে উন্নত।
খ) সমাজের মানুষের সু-দৃষ্টি, সহানুভূতি, সচেতনতা, বৈজ্ঞানিক ভাবনা সিকোফ্লেনিয়া রোগীকে দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্য করার পাশাপাশি সমাজে তাদের সঠিক সম্মান ও স্থান পেতে সাহায্য করে।
গ) দ্রুত চিকিৎসায় সিজোফ্রেনিয়া পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব।
ঘ) সিজোফ্রেনিয়া কোন জিনে, ভুতে-পরীতে ধরার বিষয় নয় বরং এটা ব্রেইনের কেমিক্যালের ব্যতয়ের জন্য ঘটে।
ঙ) সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসায় পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন রোগীকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া ওষুধ খাওয়ানোতে তদারকি করা খুবই প্রয়োজনীয়।
চ) সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ শুধু ঘুম পারিয়ে দেবে এই প্রচলিত ধারনা সত্য নয়।
ছ) নিয়মিত ফলোআপ ও ওষুধ সেবন রোগীকে স্বাভাবিক জীবন যাপন কাজকর্মে কোন প্রভাব ফেলে না।
জ) সিজোফ্রেনিয়া এটি মনোরোগ। শয়তানের প্রভাব বা বিধাতার অভিশাপ এই সকল কথার কোন ভিত্তি নাই।
ঝ) সকল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এমনকি সাধারণ চিকিৎসক এই রোগের চিকিৎসা করতে পারে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ, সকল মেডিকেল কলেজ এবং সরকারি/বেসরকারি প্রায় সকল হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। 

লেখক : অধ্যক্ষ, ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ।
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট।

 

বিডি প্রতিদিন/এএম

 
 
 

সর্বশেষ খবর