সারা বিশ্বে মানুষের মাঝে কায়িক পরিশ্রমের প্রবণতা কমছে। আর রোগব্যাধির প্রবণতা বাড়ছে। যে কোনো বয়সের মানুষের শরীর ঠিক রাখতে ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। তবে সব ব্যায়াম সব বয়সের জন্য উপযোগী নয় এবং সব বয়সে সব ধরনের ব্যায়াম সম্ভবও নয়। কিন্তু হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম, যা যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষের জন্য সহজেই সম্ভব, মানানসই, উপযোগী এবং এর মতো সহজ, ভালো ব্যায়াম আর নাই। হাঁটার উপকারিতাও অনেক। উপযুক্ত পোশাক এবং এক জোড়া ভালো জুতা ছাড়া কোনো অতিরিক্ত খরচের প্রয়োজন পড়ে না, ঘরে বাইরে যে কোনো জায়গায় করা যায়। ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী এর সময় এবং তীব্রতা বাড়ানো-কমানো যায়। হাঁটা নিয়ে হয়েছে বিস্তর গবেষণা, যার ফলাফল চমকপ্রদ। যারা নিয়মিত হাঁটা-চলার মধ্যে থাকেন, তাদের আলাদা ব্যায়ামের দরকার হয় না, যদিও সম্ভব হলে অন্যান্য ব্যায়াম করা উচিত। যারা সারা দিন অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে বসে কাজ করেন এবং অলস জীবনযাপন করেন, তাদের অবশ্যই কিছু সময় হলেও একটু একটু করে হাঁটা-চলা এবং ব্যায়াম করা দরকার। এতে শরীরের রক্ত চলাচল বাড়ে, উচ্চ রক্তচাপ, শারীরিক স্থূলতা, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়তা করে, শরীর থাকে সচল আর মন মেজাজ থাকে ফুরফুরে।
ডায়াবেটিস রোগীর উপকার
ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাট-বাজারে বা অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে ওঠা বা নামা ইত্যাদির মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন বা সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট হাঁটলে এবং শরীরের ওজন ৭ শতাংশ কমালে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে প্রায় শতকরা ৫৮ ভাগ।
আর যদি ডায়াবেটিস হয়েই থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও হাঁটা বিশেষ কার্যকর। হাঁটাহাঁটি করলে শরীরের পেশিতে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে এবং শরীরে রক্তের সুগার কমে, ওষুধ লাগে কম।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত হাঁটলে শরীরে জমে থাকা মেদ কমে, ওজন কমাতে সহায়ক হয়। অনেকেই শরীরের ওজন কমাতে শুধু ডায়েটিং করেন। কিন্তু হাঁটাহাঁটি না করে বা অলস জীবনযাপন করে শুধু ডায়েট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ওজন কমানো সম্ভব নয়, উচিতও নয়। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি ওজন নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল চাবিকাঠি স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার এবং নিয়মিত হাঁটা-চলা ও ব্যায়াম।
হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা :
নিয়মিত হাঁটলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে স্বল্প চেষ্টায় শরীরে বেশি পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এবং ধমনির ওপরও চাপ কম পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে কম। এ ছাড়া রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমে কম। ফলে রক্তনালি সরু হয় না, সহজে ব্লক হয় না, রক্তনালির দেয়াল শক্ত হয় না। তাই হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ। এছাড়া হাঁটা
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাঁটা-চলা অনেকটা উচ্চ রক্তচাপরোধী ওষুধের মতো কাজ করে। হাঁটার ফলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, আর আগে থেকেই থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রক্তের চর্বি বা কোলেস্টেরল
নিয়মিত হাঁটার ফলে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বাড়ে। হাঁটা-চলা না করলে মন্দ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের পরিমাণ বেড়ে, তা ধমনির গায়ে জমা হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যারা সপ্তাহে অন্তত তিন ঘণ্টা অথবা দৈনিক আধা ঘণ্টা করে হাঁটেন, তাদের রক্তে এলডিএল কমে যায় এবং হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে।
স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোকের অন্যতম একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হচ্ছে অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। হাঁটা-চলা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের মেদ কমে যায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে আসে। দৈনিক এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন হাঁটার মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়।
কর্মক্ষমতা : হাঁটার সময় হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এবং রক্ত সরবরাহ বাড়ে, এগুলো বেশি কর্মক্ষম থাকে। হাঁটার ফলে পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে এবং পেশির শক্তি বাড়ে। শরীরের ওজন কমে। শরীর থাকে ফিট। নিজেকে মনে হয় বেশি শক্তিশালী, মন থাকে প্রফুল এবং সার্বিকভাবে বেড়ে যায় শরীরের কর্মক্ষমতা।
ক্যান্সারের ঝুঁকি
কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি হাঁটা-চলার মাধ্যমে কমানো সম্ভব বলে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে। ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্যান্সার স্টাডিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাঁটার ফলে খাদ্যনালির নিম্নাংশের ক্যান্সারের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ হ্রাস পায়, দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, কমে যায় কোলন বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের আশঙ্কাও।
অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ
বয়স্ক পুরুষদের এবং পোস্ট-মেনোপজাল বা মাসিক বন্ধের পর নারীদের সাধারণ রোগ হচ্ছে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ। এই রোগে হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। সামান্য আঘাত বা অল্প উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে হাড়। নিয়মিত হাঁটা-চলা এ ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পোস্ট-মেনোপজাল নারী প্রতিদিন অন্তত এক মাইল হাঁটেন, তাদের হাড়ের ঘনত্ব কম হাঁটা নারীদের তুলনায় বেশি। হাঁটার ফলে হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা হ্রাস পায়, তেমনি আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগের আশঙ্কাও কমে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য
হাঁটলে মস্তিষ্কে ভালো লাগার কিছু পদার্থ যেমন এনডর্ফিন, ডোপামিন, সেরোটোনিন নিঃসরণ হয়। ফলে মনমেজাজ থাকে ভালো। হাঁটার ফলে মনে ভালো লাগার অনুভূতি জাগে, মানসিক চাপ বোধ কম হয়। এনডর্ফিন নামক রাসায়নিকের ক্রিয়া বেড়ে গেলে ঘুম আরামদায়ক হয়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ দিন হাঁটার ফলে বিষণ্নতার উপসর্গ ৪৭ শতাংশ হ্রাস পায়। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে নারীরা সপ্তাহে অন্তত দেড় ঘণ্টা হাঁটেন, তাদের বোধশক্তি সপ্তাহে ৪০ মিনিটের কম হাঁটা নারীদের তুলনায় বেশি।
হাঁটার আরও কিছু উপকার :
(১) যারা সকালে হাঁটতে অভ্যস্ত, তাদের শরীর ঝরঝরে হয়ে যায়। বেড়ে যায় শরীরের কর্মক্ষমতা। (২) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সাধারণ অসুখ বিসুখ কম হয়। অনেক সময় ইনফ্লেমেশন হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে। (৩) হাঁটার সময় হৃদস্পন্দন আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে এ দুটি ভাইটাল অঙ্গের রক্ত সরবরাহ বাড়ায়। (৪) হাঁটার ফলে পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে, পেশির শক্তি বাড়ে, শরীরের ওজন থাকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে। (৫) দুশ্চিন্তা কমায় ও মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়, শরীর মন চাঙ্গা রাখে। (৬) অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। (৭) ফুসফুসের অক্সিজেন ধারণ সক্ষমতা বৃদ্ধি।
জেনে রাখা ভালো :
হাঁটার উপকার পেতে প্রতিদিন, ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে হাঁটতে হবে। সম্ভব হলে হাঁটতে হবে যথেষ্ট দ্রুত গতিতে যেন শরীরটা একটু ঘামে। নিম্নে কিছু টিপস দেওয়া হলো :
(১) হাঁটা শুরু করার প্রথম ও শেষের ৫-১০ মিনিট আস্তে হেঁটে শরীরকে ওয়ার্মআপ এবং ওয়ার্ম ডাউন করা উচিত।
(২) হাঁটার আগে এবং পরে একটু পানি পান করুন। (৩) খাওয়ার পর পরই হাঁটবেন না। ৪৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট অপেক্ষা করুন। (৪) দুপুরের ভরা রোদে হাঁটবেন না। সকাল বা বিকেলের একটি সময় বেছে নিন। (৫) হাঁটা শেষ করে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে কিছু খেয়ে নিন। (৬) অনেককে দেখা যায় অনেকক্ষণ হেঁটে বা ব্যায়াম করার পর ক্লান্ত হয়ে কোমল পানীয় বা মিষ্টি জাতীয় খাদ্য খেয়ে ফেলেন। এগুলো ওজন কমানোর সহায়ক কিছু হয় না।
কখন হাঁটবেন :
সকালে হাঁটবেন, নাকি বিকেলে বা সন্ধ্যায়, এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, সকালের চেয়ে বিকেলে হাঁটা হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো। তবে কারও কারও মতে ভোরে খালি পেটে হাঁটা ওজন এবং রক্তে চর্বির মাত্রা কমাতে বেশি সহায়ক। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত, হাঁটার প্রকৃত সুফল পাওয়ার জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন বা মোট ১৫০ মিনিট হাঁটতে হবে, তা সকালেই হোক বা বিকেলেই হোক। তবে নির্দিষ্ট করে প্রতিদিন একই সময় বেছে নিলেই ভালো। হাঁটার উপকারিতা অনেক এবং যে কোনোভাবে হাঁটা-চলা করলে কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই হবে। তবে শারীরিক অসুস্থতা থাকলে কতটুকু হাঁটা যাবে, তা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে জেনে নেওয়া উচিত। আমাদের সমাজের সব মানুষের শারীরিক, মানসিক সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ এবং মাদক ও স্মার্টফোন আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হাঁটার কোনো বিকল্প নাই। তাই সব বয়সের, নারী-পুরুষ কম-বেশি হাঁটুন, সুস্থ থাকুন।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।