বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশে বছরে সিমেন্টের চাহিদা ৩৮ মিলিয়ন টন

দেশে বছরে সিমেন্টের চাহিদা ৩৮ মিলিয়ন টন

প্রতি বছর দেশে অবকাঠামো ও আবাসন খাতের অন্যতম নির্মাণ উপকরণ সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছে। এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করছে। সিমেন্ট শিল্পের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও ক্রাউন সিমেন্টের  ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- সাইফ ইমন

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আমদানি-নির্ভর সিমেন্ট শিল্প এখন দেশীয় শিল্প। এই আমূল পরিবর্তনের কারণ কী?

মো. আলমগীর কবির : গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশ পুরোপুরি সিমেন্ট আমদানি-নির্ভর ছিল। তবে ওই সময় সিমেন্টের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম অস্বাভাবিক রকম কমে যায়। পাশাপাশি সিমেন্ট আমদানির শুল্কও অনেক বেশি ছিল। তখন অনেক বহুজাতিক কোম্পানি এ দেশে কারখানা  স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর পরে স্থানীয় কোম্পানিগুলো সিমেন্ট খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। প্রথম দিকে সিমেন্ট উৎপাদনেও অনেক বেশি লাভ ছিল। এসব কারণেই ২০০০ সালের পর থেকে এ খাতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে। ওই সময় দেশে সিমেন্টের বাৎসরিক চাহিদা ছিল মাত্র ২.৫ মিলিয়ন টন যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হতো। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যায়, এক সময়কার আমদানি-নির্ভর সিমেন্ট খাতে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ফলে এক পর্যায়ে সিমেন্ট আমদানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে সিমেন্টের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৩৮ মিলিয়ন টন। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই নির্মাণকাজ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ছিল মাত্র ৩২ কেজি, যা ২০০০ সালে ছিল ৫৫ কেজি এবং বর্তমানে ২২৫ কেজি। বর্তমানে ৩৫টির মতো দেশি ও বিদেশি কোম্পানি সিমেন্ট উৎপাদনে রয়েছে। যদিও এদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। যেসব বাজারে গুটিকতক কোম্পানি থাকে, সেখানে পরিকল্পিত প্রতিযোগিতা হয়। যেহেতু আমাদের দেশে সিমেন্টের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি, তাই আমাদের বাজারে প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশে ভারী শিল্প খাতে সিমেন্ট শিল্প কীভাবে এগিয়ে এলো?

মো. আলমগীর কবির : নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে সিমেন্টের চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। ওই দশকেই দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় প্রথম সিমেন্ট কারখানা স্থাপিত হয়। পরবর্তী দশকের শুরুতেই অর্থাৎ ২০০০ সালের পর থেকেই আরও অনেক বড় বড় দেশীয় উদ্যোক্তা সিমেন্ট খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আসেন। যে শিল্প খাতে একসময় বিদেশি কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল, সেটি এখন প্রায় পুরোপুরি দেশীয় কোম্পানিগুলোর আওতায়। বাংলাদেশের সিমেন্ট বাজারের প্রায় ৮৫ শতাংশই দেশীয় কোম্পানিগুলোর দখলে, অন্যদিকে বাকি মাত্র ১৫ শতাংশ বিদেশি কোম্পানিগুলোর দখলে। বর্তমানে এ খাতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এ খাত থেকে সরকারি কোষাগারে শুল্ক-করের মাধ্যমে জমা করা হয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সিমেন্ট শিল্পের বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে এখন অবদান কত?

মো. আলমগীর কবির : দেশে সিমেন্টের বাজার যত বড়, রপ্তানি বাজার ততটা বড় নয়। ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মতো পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে তেমন একটা সিমেন্ট কারখানা নেই। আর যেগুলো আছে তাদের উৎপাদিত সিমেন্টের গুণগত মানও আমাদের চেয়ে অনেক কম। যেহেতু আমাদের আমদানি করা কাঁচামালের গুণগত মান অত্যন্ত ভালো, তাই আমাদের উৎপাদিত সিমেন্টের গুণগত মানও তাদের তুলনায় অনেক ভালো হয়। স্বাভাবিকভাবেই ভালো সিমেন্টের চাহিদা সবার কাছেই থাকে। আবার ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে সিমেন্ট নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ব্যবহার করাও অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। তাই মূলত ভৌগোলিক কারণে আমাদের দেশ থেকে সিমেন্ট সহজপ্রাপ্য হওয়ায় ভারতের ওইসব অঞ্চলে বাংলাদেশি সিমেন্টের বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে ভারতের এসব অঞ্চলে সিমেন্টের রপ্তানি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুরুর দিকে বাংলাদেশ থেকে নেপালেও প্রায় বছর খানেক সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছিল এবং সেখানে ব্যাপক চাহিদাও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম, নেপালে সিমেন্ট পৌঁছানোর জন্য ভারতীয় করিডোর ব্যবহার করতে হতো, তখন সীমান্ত জটিলতা ও নানা রকম বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতার কারণে নেপালে সিমেন্ট রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা এখনো মনে করি, সরকারি পর্যায় থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে নেপালে পুনরায় সিমেন্ট রপ্তানি শুরু করা যেতে পারে। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলেও অল্প কিছু পরিমাণ সিমেন্ট রপ্তানি হতো। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার পর থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টন সিমেন্ট রপ্তানি হয়ে থাকে যার মূল্য প্রায় ১১.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল দেশীয় কতটুকু, আমদানি কতটুকু?

মো. আলমগীর কবির : সিমেন্ট উৎপাদনে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে ক্লিংকার হলো প্রধান। এর পাশাপাশি জিপসাম, ফ্লাই এ্যাশ, স্ল্যাগ ও লাইমস্টোনও সিমেন্টের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর সবগুলোই আমদানিনির্ভর।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাদের সিমেন্ট রপ্তানি করেন কি না? করলে কোন কোন দেশে?

মো. আলমগীর কবির : ক্রাউন সিমেন্ট পিএলসি ২০০৩ সাল থেকেই রপ্তানি করে আসছে। মূলত ভারতের ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মতো উত্তর-পূর্বঞ্চলীয় রাজ্যগুলোই আমাদের মূল রপ্তানি বাজার। তবে রপ্তানি বাজার ছোট হলেও বর্তমানে সিমেন্ট রপ্তানির ৫০ শতাংশেরও বেশি হিস্যা ক্রাউন সিমেন্টের দখলে। এ জন্য আমরাই একমাত্র সিমেন্ট কোম্পানি যেটি তিনবার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে। আগরতলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আগরতলা উড়ালসড়ক, আগরতলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পের আগরতলা অংশের ৭ কিলোমিটার অবকাঠামোর মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলো নির্মিত হচ্ছে আমাদের ক্রাউন সিমেন্ট দিয়ে। এ ছাড়াও ক্রাউন সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত ইতোমধ্যে শেষ হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে আগরতলায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবন, নজরুল কলা ক্ষেত্র, ত্রিপুরা স্টেট অ্যাসেম্বলি হাউস, হাই কোর্ট ভবন ইত্যাদি।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই শিল্পে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়েছে?

মো. আলমগীর কবির : এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে লক্ষাধিক এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ লাখ নির্মাণ শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এখনো কি কোনো সিমেন্ট আমদানি হয়? হলে কেন? যে সিমেন্ট আমদানি হয় তা কি এখানে উৎপাদন সম্ভব?

মো. আলমগীর কবির : বর্তমানে শুধু কিছু পরিমাণ সাদা সিমেন্ট আমদানি করতে হয় যার চাহিদার পরিমাণ খুবই কম- বছরে মাত্র ২০ হাজার টন। অন্যদিকে যে সিমেন্টগুলো বহুল ব্যবহৃত হয় সেগুলো অনেক বছর আগে থেকেই আর আমদানি করতে হয় না। কারণ, চাহিদার বিপরীতে আমাদের সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি। দেশে সিমেন্টের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মে. টন, যার বিপরীতে প্রায় ৮৬ মিলিয়ন মে. টন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই শিল্প  এগিয়ে নিতে কী কী বাধা আছে?

মো. আলমগীর কবির : সিমেন্ট হলো একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম একটি সূচক। চীনে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ১৭০০ কেজি, মালয়েশিয়াতে ৭০০ কেজি, থাইল্যান্ডে ৩৮০ কেজি, পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে ৩১০ কেজি এবং বাংলাদেশে ২২৫ কেজি। এতে বোঝা যায়, সিমেন্ট উন্নয়নে কতটা অবদান রাখে। দেশের উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি  এবং অবকাঠামো খাতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে সিমেন্ট।

সর্বশেষ খবর