অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে দেশের বিনিয়োগ খাতে মন্দার লক্ষণ আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার, জ্বালানি সংকট এবং নীতিগত অস্থিরতা বিনিয়োগকে কার্যত স্থবির করে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ২৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ হার বেশ কম। একই সঙ্গে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বহু বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে, যা মহামারির সময়ের চেয়েও কম।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যা অর্থনৈতিক গতি ও আস্থার অন্যতম সূচক এখন এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি মুদ্রানীতি এবং ১৬-১৭ শতাংশ সুদের হার ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ গ্রহণকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাস সরবরাহে অনিয়মিততা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট, যা কারখানা উৎপাদন ব্যাহত করছে। ব্যবসায়ীরা বারবার প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করছেন।
হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, বিনিয়োগ কার্যক্রম কার্যত থমকে গেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত না হলে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছে না। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী মনে করেন, এটি শুধু স্বল্পমেয়াদি মন্দা নয়, বরং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে আস্থার গভীর ক্ষয়। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম সতর্ক করে বলেন, প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ অপরিহার্য।
বর্তমান ডিসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ সুদের হার, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি সংকট ও রাজনৈতিক সহিংসতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে।’ তিনি আর্থিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার, অবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যবসা সহজীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মসরুর রিয়াজ বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশে আটকে আছে, যা স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক কম। তিনি মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, অবকাঠামো ঘাটতি, জ্বালানি সংকট ও নীতিগত অনিশ্চয়তাকে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সতর্ক করে বলেন, ‘এটি এক সংকটকাল। নতুন বিনিয়োগ ছাড়া শিল্প, কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে।’ সাউথ এশীয় নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। অর্থনীতিবিদরা একমত, যদি দ্রুত ও কার্যকর সংস্কার না হয়, তবে বিনিয়োগ মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।