রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের পর এবার উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন নিয়ে জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে ভারতের শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেই। রাষ্ট্রপতি পদে উত্তর ভারত থেকে রামনাথ কোবিন্দকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ শিবির। এই পদে কোবিন্দের জয় যখন নিশ্চিত ঠিক তখনই সোমবার সন্ধ্যায় উপরাষ্ট্রপতি পদে দক্ষিণ ভারত থেকে ভেঙ্কাইয়া নাইডুকে প্রার্থী করেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ’রা। উপ-রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হওয়ার পর রাতেই কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন ও তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রালয় থেকে পদত্যাগ করেন নাইডু। (বস্ত্র মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে দেওয়া হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং খনি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং টোমারকে নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে)।
১৯৪৯ সালের অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে জন্ম মুপ্পাভারাপু ভেঙ্কাইয়া নাইডুর। নেল্লোরের বি.আর হাইস্কুল থেকে পড়াশোনার পর ওই কলেজ থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ডিপ্লোমেটিক স্টাডিসের স্নাতক হন। এরপর আইনের স্নাতক হন তিনি। ভেঙ্কাইয়া নাইডু প্রথমে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পরে আরএসএস’এর স্বয়ংসেবক হন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত অন্ধ্র্রপ্রদেশে জনতা পার্টির যুব শাখার সভপতি ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ ও ১৯৮৩ সালে দুইবার অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত রাজ্য বিজেপি’র সভাপতি পদে ছিলেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় স্তরে দলের কাজে গুরুত্ব বাড়তে থাকে নাইডুর। বরাবরই সুবক্তা হিসাবে পরিচিত নাইডু ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দলের অন্যতম জাতীয় সাধারণ সম্পাদক পদেত ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ পর্যন্ত বিজেপির মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেছেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বিজেপির জাতীয় সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৮ সালে প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন, এরপর ২০০৪ ও ২০১০ সালেও কর্ণাটক থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হন তিনি। ২০১৬ সালে ফের রাজস্থান থেকে সাংসদ হন।১৯৯৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ’এর জয়ের পর নাইডুকে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী করেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার আসার পর ফেল কেন্দ্রের মন্ত্রী হন। নগরোন্নয়ন-শহরাঞ্চরেল দারিদ্র দূরীকরণের সঙ্গে সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর গত বছরের জুলাইয়ে সংসদীয় মন্ত্রণালয়টি সরিয়ে তাঁকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালীন বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাংসদ সামলানোর কাজে নাইডু যথেষ্ট অভিজ্ঞতার সঙ্গে কাজ সামলেছেন। বাজপেয়ী-আদবানির যুগ থেকে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ,দুই যুগেই তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। এবার উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করে ভেঙ্কাইয়া নাইডুকে আরও একটি গুরু দায়িত্ব দেওয়া হল বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল। উপ-রাষ্ট্রপতি পদে সংখ্যার দিক (এখানে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের মোট ভোটের সংখ্যা ৭৯০) থেকে অনেকটাই এগিয়ে নাইডু। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচিত হলে তিনি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হবেন। লোকসভায় শাসক শিবিরের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সেখানে বিরোধী শিবির শক্তিশালী। সেক্ষেত্রে সিনিয়র সাংসদ হিসাবে নাইডু তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ হাতে সভা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই ভেঙ্কাইয়া নাইডুকেই লড়াই করতে হবে কংগ্রেস সহ বিরোধী শিবিরের সর্বসম্মত প্রার্থী সাবেক আইএএস কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীর বিরুদ্ধে। তাঁর জন্ম ১৯৪৬ সালের ২২ এপ্রিল দিল্লিতে। তাঁর ঠাকুরদাদা ছিলেন দেশটির জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। দাদু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সদস্য ও ভারতের প্রথম গর্ভনর জেনারেল চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হন গোপালকৃষ্ণ। ১৯৬৮ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) অফিসার হন তিনি, তামিলনাড়– রাজ্যেই ১৯৮৫ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব সামলান। এরপর ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত উপরাষ্ট্রপতির সচিব হন, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির যুগ্মসচিব এবং ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতি সচিব পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে মিনিস্টার অফ কালচারাল’এর দায়িত্ব পান, ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় হাইকমিশনার পদে নিযুক্ত হন তিনি। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ২০০২ সালে নরওয়ে এবং তার পর আইসল্যান্ডেও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন গোপালকৃষ্ণ। বেশকয়েকটি বইয়ের লেখাক গোপালকৃষ্ণ বর্তমানে অশোক বিশ্বদ্যিালয়ের ইতিহাস ও রাজনীতির অধ্যাপক।
আগামী ৫ আগষ্ট উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন। তার আগে মঙ্গলবার দুই শিবিরের প্রার্থীরাই নিজেদের মনোনয়ন পত্র জমা দেন। এদিন সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ সংসদে প্রথম মনোনয়ন পত্র জমা দেন ভেঙ্কাইয়া নাইডু। এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি, রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যরা, বিজেপির বরিষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আডবানী, মুরলী মনোহর যোশী, বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ প্রমুখ। মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েই সাংবাদিকদের তিনি জানান ‘যদি আমি নির্বাচিত হই তবে আমি ভারতের উপরাষ্ট্রপতি’র মর্যাদা রক্ষা করবো এবং সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবো’।
এদিন ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময় যেভাবে আডবানীর মতো বিজেপির সিনিয়র নেতাদের নিয়ে ঐক্যের ছবি তুলে ধরেছিলেন মোদি। ঠিক সেভাবেই গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীর মনোনয়নের সময়ও বিরোধী শিবিরের ঐক্য চোখে পড়েছে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ মনোনয়ন পত্র জমা দেন গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী। গোপালকৃষ্ণের সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গান্ধী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, তৃণমূলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন, এনসিপি নেতা তারেক আনোয়ার, সিপিআই নেতা ডি.রাজা, ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি, জেডিইউ নেতা শরদ যাদব সহ বিরোধী শিবিরের নেতারা। এদিকে সংখ্যার হিসাবে পিছিয়ে থাকা গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে জিতিয়ে আনতে রাষ্ট্রপতি পদের মতোই বিবেক ভোটের ডাক দিয়েছেন সোনিয়াসহ বিরোধী নেতারা।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার