সুরাতুল হুমাজা আল কোরআনের ১০৪ নম্বর সুরা, যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এতে ৯টি আয়াত আছে। হুমাজা শব্দের অর্থ নিন্দুক, পরনিন্দাকারী, ছিদ্রান্বেষী।
মানুষের সামনে কিংবা পেছনে নিন্দা চর্চা করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এই সুরায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদশালী কৃপণদের আজাবে আক্রান্ত ও শোচনীয় অবস্থার কথা বলা হয়েছে। আসুন, সুরা হুমাজার মর্মকথা জেনে সে অনুযায়ী আমলে সচেষ্ট হই।
সুরা হুমাজার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ
(১) দুর্ভোগ ও ধ্বংস ওই ব্যক্তির জন্য, যে সামনে-পেছনে মানুষের নিন্দা করে।
(২) যে সম্পদ জমায় এবং তা বারবার গণনা করে।
(৩) সে ধারণা করে যে তার ধনসম্পদ তাকে অমর করে রাখবে।
(৪) কখনোই নয়, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে ‘হুতামা’য়।
(৫) হে নবী! আপনি কি জানেন ‘হুতামা’ কী?
(৬) ‘হুতামা’ আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন।
(৭) যা মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে।
(৮) নিশ্চয়ই এটা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে।
(৯) দীর্ঘায়িত স্তম্ভে।
তাফসিরবিদদের বর্ণনায় হুমাজা ও লুমাজা:
এই সুরায় বর্ণিত হুমাজা ও লুমাজা ভিন্ন নাকি অভিন্ন—এ ব্যাপারে মুফাসসিরদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হুমাজা গিবতকারী আর লুমাজা ছিদ্রান্বেষী।
হাসান ও আতা (রহ.)-এর মতে, হুমাজা ওই ব্যক্তি, যে মুখের ওপর মানুষের নিন্দা করে। খোঁচা মারে। আর লুমাজা হলো কারো অনুপস্থিতিতে নিন্দা করা।
কাতাদা (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, চোখের ইশারা-ইঙ্গিতে মানুষের দোষ বর্ণনা করার নাম হুমাজা আর জিহ্বা দিয়ে খারাবি বর্ণনা করা লুমাজা। (জাদুল মুয়াসসার : ৪/৪৮৯)
এসবের মোদ্দাকথা হলো, চলনে-বলনে, কাজে-কর্মে, ইশারা-ইঙ্গিতে গোপনে, প্রকাশ্যে নিন্দার মাধ্যমে যারা অন্যকে কষ্ট দেয় তারাই এই আয়াতে উদ্দেশ্য।
আমরা দেখতে পাই, আমাদের সমাজে এমন অপরাধ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এমন পাপকাজে জড়িত ব্যক্তি পরকালে ‘ওয়াইল’ জাহান্নামে নিপতিত হবে। ‘ওয়াইল’ অর্থ ধিক, ধিক্কার, লজ্জা, ধ্বংস ইত্যাদি। তাফসিরে তবারির বর্ণনায় ওয়াইলের অর্থ মহাধ্বংস বলা হয়েছে। ওয়াইল মূলত জাহান্নামের একটি গভীর উপত্যকা, যে উপত্যকায় জাহান্নামিদের পুঁজ, বমি প্রবাহিত হবে।
প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পরনিন্দা ঘৃণিত কাজ:
পরচর্চা, পরনিন্দা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। হোক তা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে; যা এই সুরার প্রথম আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
যে সম্পদ জমায় আর গণনা করে:
আলোচ্য সুরার দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সম্পদ অর্জনের নেশায় মত্ত থাকা। আমাদের সমাজে এমন মানুষের অভাব নেই, যারা সম্পদের পাহাড়ের মালিক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর দেখানো পথে ব্যয় করে না। তারা সম্পদ জমায় আর জমায়—গুনে গুনে রাখে। ইমাম সুদ্দি ও ইকরেমা (রহ.)-এর বর্ণনা মতে, যারা অনন্তকালের জন্য সম্পদ গণনা করে ও জমা করে, তাদের জন্যও ‘ওয়াইল’ নামের জাহান্নাম রয়েছে। (জাদুল মুয়াসসার : ৪/৪৮৯)
এমন ব্যক্তি সম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আল্লাহর বর্ণিত যথাযথ খাতে ব্যয় করে না।
কিছু সম্পদশালী ব্যক্তি এমন আছে, যারা ধারণা করে যে তার ধনসম্পদ তাকে অমর করে রাখবে। সম্পদের বলে অনন্তকালের জন্য বেঁচে থাকবে। মৃত্যু তাকে ছুঁতে পারবে না। দৈনন্দিন জীবনে সে এমন কর্মকাণ্ড করে, যা দেখে মনে হয়, মৃত্যু তাকে ধরতে পারবে না। তাফসিরে তাবারিতে এসেছে, ‘তারা ধারণা করে যে সম্পদ তারা হিসাব করে করে জমিয়েছে, তা তাদের দুনিয়ায় চিরস্থায়ী করবে। তার থেকে মৃত্যুকে দূর করবে।’
দুনিয়ায় কি কখনো এমন হয়েছে যে সম্পদের কারণে কেউ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? এমনটা কখনো হয়নি আর হবেও না। বরং সম্পদের পূজা তাকে জাহান্নামের নিকৃষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবে। তার চূড়ান্ত ধ্বংস নিশ্চিত করবে।
ধন-সম্পদের পূজারিরা জাহান্নামে থাকবে:
যারা ধন-সম্পদকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, সম্পদের আরাধনা করে, পূজা করে, তাদের নিশ্চিত ঠিকানা জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘কখনো না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়।’ মহান আল্লাহ দৃঢ় নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন, সম্পদ কখনোই চিরস্থায়ী হবে না, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শুধুই সম্পদ অর্জনের পিছনে ছুটবে। সম্পদ কামাইয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম হালাল-হারামের তোয়াক্কা করবে না। তাদের জন্য আছে হুতামা জাহান্নাম, যেখানে তাদের কৃত পাপের জন্য আজাব দেওয়া হবে।
হুতামার ভয়াবহ শাস্তির বিবরণ:
সম্পদের পূজারিদের হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের এই অংশকে ‘হুতামা’ বলা হয় কেন, তাফসিরে মাতুরিদির বর্ণনায় এসেছে, হুতামা একটি জাহান্নামের নাম। তার এই নামকরণ হয়েছে, কারণ যে-ই সেখানে নিক্ষিপ্ত হবে, সেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হবে। হাড্ডি থেকে গোশত খাওয়ার পর আমরা হাড্ডিগুলোকে যেভাবে দাঁত দিয়ে পিষে ফেলি। টুকরা টুকরা করে ফেলি। এই জাহান্নামে যারা নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের অবস্থাও তেমনি হবে। আবার কেউ বলে, সম্পদ পূজারিরা তাদের সম্পদসহ এই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
হৃদয় অবধি পৌঁছবে যে আগুন:
হুতামার বর্ণনায় আল্লাহ বলেছেন, ‘হুতামা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন, যা মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে।’
এই আগুন ব্যক্তির চামড়া, গোশত, হাড্ডি সব জ্বালিয়ে খেয়ে ফেলবে। একটা পর্যায়ে তা জাহান্নামির হৃদয় অবধি পৌঁছবে এবং তার অন্তরকেও জ্বালাবে। ইমাম ফাররার মতে, দহনের কষ্ট ব্যক্তির অন্তর অবধি পৌঁছবে। আয়াতে অন্তরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কারণ অন্তরের কষ্ট ব্যক্তিকে মরণ অবধি পৌঁছে দেয়, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো জাহান্নামে মরণ থাকবে না। এ কারণে অনন্তকালের জন্য কষ্টের অনলে দহন হতে হবে। (তাফসিরে তবারি, ৩৪/৬২৩)
আসুন, গিবত, পরনিন্দা আর অন্যের ত্রুটি তালাশের পেছনে ছোটা বন্ধ করি। বরং নিজের প্রতি দৃষ্টি দিই। নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করি। আর আল্লাহর দেওয়া সম্পদ তাঁর দেখানো পথে ব্যয় করি। পাপের রাস্তা পরিহার করি। জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ প্রসারিত করি। (লেখক: খতিব, বাইতুল আজিম, জামে মসজিদ, রংপুর)