দোজাহানের সরদার, বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এমন পূর্ণাঙ্গ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও অনন্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর সর্বাঙ্গীণতা, পরিপূর্ণতা ও সর্বজনীনতা মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণে ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইবাদত হোক বা লেনদেন, নৈতিকতা হোক বা সামাজিকতা, বিচারব্যবস্থা হোক বা রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা হোক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক, যুদ্ধ কৌশল হোক বা পারিবারিক সমস্যা—সব ক্ষেত্রেই রহমতের মহানবী (সা.)-এর মহৎ সত্তা পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ নমুনা হিসেবে প্রকাশিত হয়। মহানবী (সা.)-এর সিরাত তাই মানবজীবনের প্রতিটি দিককে আপন আচ্ছাদনে আবৃত করেছে।
রাসুল (সা.)-এর নবুয়তের পূর্ববর্তী জীবনে আমরা তাঁকে দেখি এক বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, উত্তম স্বামী, প্রিয় বন্ধু, অনাথদের অভিভাবক, বিধবা ও অভাবগ্রস্তদের সহানুভূতিশীল সঙ্গী এবং আমানত ও সত্যবাদিতার প্রতীক হিসেবে।
আর নবুয়তপ্রাপ্তির পর তিনি হয়ে ওঠেন মহৎ দাঈ (আহ্বানকারী), গাজওয়াত ও অভিযানে মহান সেনাপতি, মদিনা রাষ্ট্রের গৌরবময় প্রধান, সফল হজের পরিচালক, দক্ষ শিক্ষক, অদ্বিতীয় পথপ্রদর্শক এবং সাফল্যমণ্ডিত রাজনৈতিক নেতা।
সিরাতে নববী ইসলামের স্থায়ী মুজিজা
সিরাতে নববী ইসলামের এক স্থায়ী মুজিজা। কারণ তা পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রতিটি যুগ ও প্রতিটি সময়ে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি স্থান, প্রতিটি পরিবেশ ও প্রতিটি সময়ে এটি দিশাহারা মানবতার জন্য শুধু পথপ্রদর্শকই নয়, বরং চিরস্থায়ী গন্তব্যও বটে।
আজ পর্যন্ত বিশ্ব মানবতা মহানবী (সা.)-এর মহিমাময় সত্তাকে যেমন গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে স্মরণ করেছে, তাঁর জীবনের প্রতিটি দিককে যে যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে সংরক্ষণ করেছে, সে সম্মানের সামান্য অংশও আর কারো ভাগ্যে আসেনি? তাঁর মুখের প্রতিটি শব্দ, আচরণ ও চলাফেরার প্রতিটি ভঙ্গি, তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জীবনের প্রতিটি রেখাচিত্র আজও সংরক্ষিত রয়েছে এবং তাঁর মহৎ জীবনের প্রতিটি অবস্থা সিরাতগ্রন্থের পৃষ্ঠায় বিস্তারিতভাবে সুরক্ষিত ও অক্ষত অবস্থায় বর্তমান?
আধুনিক যুগে সিরাতের আলোকবর্তিকা
পবিত্র সিরাতের দিকনির্দেশনার প্রয়োজন প্রতিটি যুগেই ছিল। তবে বর্তমান সময়ে এর গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা আরো বেড়ে গেছে। আজ সমগ্র পৃথিবী দ্রুতগতিতে এক বৈশ্বিক ব্যবস্থার এবং এক সর্বজনীন নীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আকাশ ছুঁইছুঁই করছে, প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সামনে আসছে।
বস্তুবাদের বন্যা এক অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে; সর্বত্র ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-ফুর্তির সামগ্রী প্রাচুর্যে ভরে গেছে। শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামও ধীরে ধীরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সজ্জিত হচ্ছে।
কিন্তু এর বিপরীতে সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ আজ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে। ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে; বরং মনে হচ্ছে, সেই জাহিলিয়াতের যুগ আবার ফিরে আসতে চলেছে, যার অবসান ঘটানোর জন্যই আল্লাহ তাআলা মহানবী (সা.)-কে প্রেরণ করেছিলেন। কুসংস্কার, মূর্খতা, লুণ্ঠন, কন্যা হত্যা, অধিকার হরণ—সব কিছু আজকের জাহিলিয়াতের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমনই এক অশান্ত সময়ে, ধর্মহীনতার কবলে পতিত এই পরিবেশে সমগ্র মানবজাতি একজন সত্যিকার পথপ্রদর্শকের অপেক্ষায় আছে। আর এ পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে শুধু একটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে একটি আলোকবর্তিকা, যা তার আলোকরশ্মি দিয়ে পথিকদের হাত ধরে নিয়ে যেতে পারে প্রকৃত গন্তব্যের দিকে। এমন এক আলো, যার দিশারিতে মানুষ শুধু দুনিয়ার শান্তি-সমৃদ্ধিই নয়, বরং আখিরাতের মুক্তিও লাভ করতে পারে।
সিরাতচর্চায় মুসলিমদের করণীয়
১. মুসলিম উম্মাহর সাধারণভাবে এবং বিশেষত আলেমসমাজের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে তারা বিশ্ব জাতিসমূহের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করবে। কারণ নবুয়তের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এ দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। তাই যুগের চ্যালেঞ্জ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক যাই হোক না কেন, সেগুলোর কারণ ও মূল বিশ্লেষণ করে, সিরাতে তয়্যিবার আলোকে তার সমাধান ও করণীয় নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ফজিলত, শামায়েল ও বৈশিষ্ট্য অধ্যয়ন করার পাশাপাশি সিরাতে নববীকে সমসাময়িক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। গবেষণা, বর্ণনা ও যুক্তির আলোকে সিরাত সম্পর্কে ওঠা নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দয়া ও করুণা, শ্রম ও মমতা, আল্লাহভীতি ও অনুতাপ, সাহসিকতা ও আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও দানশীলতা, প্রজ্ঞা ও সংযম, আত্মত্যাগ ও দায়িত্বশীলতা, জ্ঞান ও বিনয়, ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর ভরসা, পারিবারিক জীবনে উত্তম সঙ্গী, দয়ার্দ্র নেতা, মিসকিনদের অভিভাবক; তদ্রূপ জাতীয় জীবনে ন্যায় ও ইনসাফ, সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব, রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রজাদের যত্ন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বন্ধুদের খেয়াল রাখা, শত্রুদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার এসব মহৎ চরিত্র ও গুণাবলি যার কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে (অসাধারণ চরিত্র)-এর মর্যাদা প্রদান করেছেন, সেই মহৎ গুণাবলির সঙ্গে আমরা অপরিচিত, অজ্ঞাত ও অচেনা হয়ে গেছি।
ফলস্বরূপ, ইসলামবিদ্বেষী গবেষক ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রাচ্যবিদরা বিশ্বনবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বকে ঘিরে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। তাঁকে শুধু বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণে তুলে ধরেছে, তাঁর ফজিলত ও অস্বীকৃতি দিয়েছে, নবুয়তের মর্যাদা, নবুয়তের বাস্তবতা ও ওহির সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁকে নিয়ে অপমান ও কটূক্তি শুরু হয়েছে। এর জন্য দায়ী প্রথমে আমরাই। কারণ সিরাতে নববীর অধ্যয়ন এবং এর প্রকৃত গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা আমাদের অন্তর থেকে মুছে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রা এমন হয়ে পড়েছে যে সিরাত অধ্যয়নের অভাব বা ঘাটতির ফলে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার অস্তিত্ব আমরা অনুভবই করি না।
অতএব, এ সত্যটি তুলে ধরতে হবে যে ইসলাম শুধু প্রাথমিক যুগেই নয়, বরং প্রতিটি যুগের সমস্যার সমাধান দেয়। আর সমস্যার সমাধান ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য সিরাতে তয়্যিবার দিকে ফিরে আসা প্রতিটি যুগের জন্য অপরিহার্য।
৩. অমুসলিমদের কাছে সিরাতে তয়্যিবার নৈতিক, আত্মিক ও সর্বজনীন দিকগুলো পৌঁছে দিতে হবে। এ জন্য সিরাতকে সঠিক পদ্ধতিতে, যুগোপযোগী উপায়ে এবং প্রতিটি ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে।
৪. শুধু ইবাদতেই সীমাবদ্ধ না থেকে, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক কৌশল ও অন্যান্য জাতির সঙ্গে সম্পর্ক ও আচরণের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাস্তব নমুনাকে সামনে রাখতে হবে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে যে আজ যদি বিশ্ব বস্তুগত উন্নতির পাশাপাশি নৈতিক ও আত্মিক উন্নতিও চায়, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জীবন কামনা করে, তবে তাকে আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ শতক পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
৫. সিরাতের মৌলিক ও আধুনিক সব ধরনের গ্রন্থ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
৬. এসবের পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই সিরাতে তয়্যিবার প্রকৃত রুহ বুঝতে হবে, তা আমাদের চরিত্র ও কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এবং বাস্তব জীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণকে প্রসারিত করতে হবে। কেননা যতক্ষণ না আমাদের জীবন সিরাতে তয়্যিবার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, ততক্ষণ বস্তুগত উন্নতির সব উপকরণ হাতে থাকা সত্ত্বেও আমরা অবনতিই বরণ করব।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন