ভারতের সাবেক সেনা কর্মী রাম কিষাণ গ্রেওয়াল (৬৫)-এর আত্মহত্যা এবং ভোপালের এনকাউন্টারে জঙ্গি হত্যা-এই দুই ইস্যুতে নাজেহাল অবস্থা বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা (এনডিএ) সরকারের। ঠিক সেসময় এই দুই ইস্যুতে মুখ খুলে বিজেপি বিরোধী জাতীয় রাজনীতিতে নতুন জল্পনার ইঙ্গিত দিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা ব্যানার্জি।
মঙ্গলবার ‘এক পদ এক পেনশন’ ইস্যুতে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে দিল্লিতে আত্মহত্যা করেন রাম কিষাণ। পরদিন বুধবার এই ঘটনা নিয়ে দিনভর চলে রাজনৈতিক তরজা। সেনাকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনাকে ঘিরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনায় মুখর হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। নিহত সেনা কর্মীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হতে হয় মোদি বিরোধী বলে পরিচিত কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আটক হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাহুল ও কেজরিওয়ালের সমর্থনে ট্যুইটে বিজেপিকে তুলোধনা করেন মমতা। পাশাপাশি ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে এই ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হতে মমতার নির্দেশে দিল্লিতে পৌঁছেন দলের রাজ্যসভার সংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। পাশাপাশি হরিয়ানায় নিহত সেনাকর্মীর বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে সমবেদনা জানানোর জন্যও ডেরেক ও’ব্রায়েনকে নির্দেশ দেন মমতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে এই দুই ইস্যুকে সামনে রেখেই কি লোকসভার নির্বাচনের সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেল?
কয়েক দিন আগেই কালীঘাটে তৃণমূলের নীতিনির্ধারণ কমিটির বৈঠকে মমতা সাফ জানিয়ে দেন বিজেপি’ই তাদের প্রধান শত্রু। কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও বঞ্চনার অভিযোগ তোলেন তিনি। এরপর গত মাসের শেষে পথ দুর্ঘটনায় মমতার ভাতিজা অভিষেক ব্যানার্জির দুর্ঘটনার পরই যেভাবে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী মমতার সঙ্গে কথা বলেন কিংবা গতকাল বুধবার ট্যুইট করে দিল্লি পুলিশের হাতে রাহুলের আটক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সবর হয়েছেন, তাতে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে কংগ্রেস এবং তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী দুই দলই ফের কাছাকাছি জায়গায় আসতে চাইছে। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কেউ কারও ছায়া পর্যন্ত মারায়নি। কিন্তু সেই ঘটনা এখন অতীত। পুরনোকে পিছনে ফেলে নতুন করে একটা সমীকরণ করতে চাইছে এই দুই জাতীয় দল। পাশাপাশি সংসদেও এই দুই দল বিজেপির বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করার চিন্তাভাবনা নিয়েছে। তাছাড়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ দলের সঙ্গেও মমতার আগেই বোঝাপড়া ছিল। তাই সব মিলিয়ে বিজেপি’র বিরোধী মহাজোটের হাতকে শক্তিশালী করাই লক্ষ্য মমতা’র? ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কি বড় কোন লক্ষ্য নিয়েই মমতা এই কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছেন? অন্তত রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা ধারনা সেটাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জানান জাতীয় রাজনেতিতে আসন সংখ্যা দিক থেকেই নয়, নেতৃত্বের দিক থেকেও সামনের সারিতে আছেন মমতা। কারণ মমতা ছাড়াও আর যে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার হতে পারেন তাদের মধ্যে এআইএডিএমকে প্রধান জে জয়ললিতা শারীরিকভাবে অসুস্থ। নীতিশ কুমারের দ্বিতীয় ইনিংস ভাল চলছে না, তার নেতৃত্বে রাজ্যের সুশাসন নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) মায়াবতী ও সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-এর অখিলেশ যাদবের মধ্যে কারও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই কারণ একজন অন্তর্ভুক্ত হলে আরেকজন তার প্রবল বিরোধিতা করবে। সেক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে যে মহাজোটের কথা বলা হচ্ছে সেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলির মধ্যে অন্যতম মুখ হয়ে উঠতে পরেন মমতা। সেই সম্ভাবনাই প্রবল হয়ে উঠছে। আর সেই সম্ভাবনা যত প্রবল হচ্ছে, সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মমতা ব্যানার্জির দল যদি পরবর্তী নির্বাচনে (২০১৯ লোকসভা নির্বাচন)-এ ৩৫ টির বেশি আসনে জেতে তবে মমতা যে কেন্দ্রে বিজেপি বিরোধী নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হবেন তাই নয়, ১৯৯৬ সালের মতো এইচ ডি দেবগৌড়ার মতো ‘সিচ্যুয়েশনাল লিডার’ হিসাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে চলে গিয়েছিলেন, মমতার ক্ষেত্রেও সেরকম সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রীতিমতো অংক কষেই বিজেপির বিরুদ্ধে যে ফ্রন্ট গঠন করতে চাইছে আমরা সকলেই জানি যে কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে একটা নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে এবং সেই সুযোগটা তার সামনে আছে। অন্যদিকে রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপির বিরোধীতা করলে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে মমতার পক্ষে। ফলে কৌশলগত কারণেই তিনি পথ অবলম্বন করতে চাইছেন মমতা।
এদিকে নিহত সেনাকর্মীর পরিবারকে সমবেদনা জানানো নিয়েও ফের একবার সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনীতির আঙিনা। বৃহস্পতিবার হরিয়ানার ভিওয়ানি গ্রামে রাম কিষাণ গ্রেওয়ালের শেষকৃত্যে যান রাহুল গান্ধী, কংগ্রেস সাংসদ কমল নাথ, কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা, হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা ভুপিন্দার সিং হুডা, আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন সহ অন্যান্য নেতা-নেত্রীরা। উপস্থিত ছিলেন হরিয়ানার বিজেপি মন্ত্রী কৃশনলাল পাঁবর, স্থানীয় বিজেপি সংসদ সদস্য ধরমবীর। তারা সকলেই পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাদের এক কোটি রুপি আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষনা দেন কেজরিওয়াল, পাশাপাশি পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার কথাও জানান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী।
অন্যদিকে সেনাকর্মীর আত্মহত্যার ইস্যুতে দেশজুড়ে চাপের মুখে পড়ে নিহত সাবেক সেনাকর্মীর পরিবারকে দশ লাখ রুপি আর্থিক সহায়তা ও পরবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষনা করে হরিয়ানার বিজেপি শাসিত সরকারও। সবমিলিয়ে সেনা কর্মীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা যেভাবে তেড়েফুঁড়ে উঠেছে তাতে আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি’র রক্তচাপ বেশ খানিকটা বেড়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিডি-প্রতিদিন/ ০৩ নভেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ/০৬