বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১২৪

ক্রিকেট ব্যাট নয় অস্ত্র

মির্জা মেহেদী তমাল

ক্রিকেট ব্যাট নয় অস্ত্র

ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ছিলেন যুবনেতা। রাজনীতির পথে হাঁটতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ভালো লাগেনি তার।  তা ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। তুলে নিলেন অস্ত্র। চার ছক্কা বাদ দিয়ে লাশ ফেলা শুরু করলেন। পাশাপাশি চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি। এক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসী। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন। পুলিশও সামনে ঘেঁষতো না। টেনে ধরা যাচ্ছিল না তার লাগাম। অবশেষে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তপ্ত বুলেট তাকে থামাল। নারায়ণগঞ্জের ডেভিড। মোমিনউল্লাহ ডেভিড। শহর যুবদলের নেতা ছিলেন তিনি।

প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নারায়ণগঞ্জের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে পুলিশও রেহাই পায়নি। পুলিশকে মারধর ও গুলি ছিনিয়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটান এই ডেভিড। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ। অবশেষে দল ক্ষমতায় থাকতেই র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন দানবে পরিণত হওয়া মোমিনউল্লাহ ডেভিড। পুলিশের হিসাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হামলাসহ ডেভিডের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা ছিল।

মোমিনউল্লাহ থেকে ডেভিড : ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমিতে। ভালো ব্যাট করতেন। অনুকরণ করতেন অস্ট্রেলিয়ান জনপ্রিয় ক্রিকেটার ডেভিড বুনকে। ডেভিড বুনের ব্যাটিং স্টাইল রপ্ত করেছিলেন ভালোভাবেই। ক্রিকেট একাডেমির কোচ তাকে ডেভিড বলেই ডাকতেন। সেই থেকে তার নাম হয় মোমিনউল্লাহ ডেভিড। পরিচিতি পান ডেভিড নামে। এই ডেভিড ক্রিকেট খেলতে খেলতে এক সময় জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। ক্রিকেট ব্যাট চালাতে তিনি যেমন ছিলেন পারদর্শী, অস্ত্রও চালাতেন ঠিক তেমনি। এক সময় অস্ত্র আর ব্যাট দুই-ই চালাতে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট ব্যাট ফেলে নিত্যনতুন অস্ত্র তার হাতে শোভা পেতে থাকে। সন্ত্রাসী থেকে বনে যান শীর্ষ সন্ত্রাসীতে। এক সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের অপরাধ জগতের ডন। ১৯৯০ সালে ডেভিড সন্ত্রাসের পথে হাঁটতে থাকলেও সেই সময়ে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সেই সময়ে বিএনপির দুই ডজন সন্ত্রাসী বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ওই অপরাধীরা গা-ঢাকা দিলেও আড়ালে যাননি ডেভিড। এলাকায় থেকেই গা-ঢাকা দেওয়া অপরাধীদের আস্তানাগুলো দখলে নিতে শুরু করেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ হিসেবে উত্থান ঘটে মোমিনউল্লাহ ডেভিডের। বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অপরাধীরাও তার কাছে তখন নস্যি। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ডেভিড দ্রুত এগিয়ে যান। তখন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জে অপরাধ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন। তার কাছে অস্ত্র যেন একটি খেলনা দ্রব্য। প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি অফিস আদালতও তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। কোনো কিছুতেই তার এই অগ্রযাত্রাকে রোধ করা যাচ্ছিল না। অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলেন তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। মূলত এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালে জোড়া খুনের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন ডেভিড। কালাম ও কামাল নামে দুই যুবককে হত্যা করে ডেভিড। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কিছু করতে না পারলেও ২০০১ সালের পর তৎকালীন ছাত্রদলের এই নেতা দানবে পরিণত হন। খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনে সশস্ত্র হামলা চালায় ডেভিড। এতে পাণ্ডা নামে এক যুবক নিহত হন। এ ছাড়া মিশনপাড়া এবং চাষাঢ়ায় গুলি করে হত্যা করেন মনির নামে এক যুবককে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ডেভিড সোনার হরিণ হিসেবে বেছে নেয় সন্ত্রাসকে। এ পথ ধরে ডেভিড কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিলে অনেক দূর এগিয়েছিল। সে সময়ে প্রতিদিন তার অবৈধ আয় ছিল ৭০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। ডেভিডের এই অবৈধ আয়ের উৎস ছিল সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শীতলক্ষ্যা নদীর চাঁদাবাজি, গার্মেন্ট জুট ব্যবসা, চোরাই তেল ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসের মহীরুহে পরিণত হন ডেভিড। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন নারায়ণগঞ্জে। ডেভিডের আমলে টেন্ডারকে নারায়ণগঞ্জে প্রায় প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটত। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব- অনেকেই তার হাতে প্রকাশ্যে নাজেহাল হয়েছেন। ভয়ে কেউ টুঁ-শব্দটি করার সাহস পেত না। সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের ব্যবসায়ীরা ছিলেন মোমিনউল্লাহ ডেভিডের কাছে জিম্মি। এমন কোনো ব্যবসায়ী ছিলেন না, ডেভিড ও তার দল-বলের নির্যাতন সহ্য করেননি। তাদের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য এমনটাই বেড়ে যায় যে, কোনো ব্যবসায়ী এলসি খুললেই চাঁদা দিতে হতো। ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বর রাজধানীর মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে গ্রেফতার হন মোমিনউল্লাহ ডেভিড। সেখানেই ক্রসফায়ারে নিহত হন নারায়ণগঞ্জের গডফাদারে পরিণত হওয়া মোমিনউল্লাহ ডেভিড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর