জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশ থেকে দেদার অর্থ পাঠাচ্ছে জঙ্গিরা। এ অর্থ নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে এবং বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-অপকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ ইউরোপ, আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশ থেকে এই অর্থ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস, হুন্ডি ও ভুয়া রপ্তানি বিল। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দেশের বাইরে থেকে জঙ্গিদের কাছে অর্থ আসছে, যা নির্বাচনী ষড়যন্ত্রে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্প্রতি রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকা থেকে জেএমবির তিন সদস্যকে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতারও করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদেও এমন তথ্য জানিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিরা বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। যারা টাকা পাঠাচ্ছেন তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্য বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে অ্যান্টি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জানা গেছে, জঙ্গি দমনে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে। এ জন্য সারা দেশের জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে এবং জঙ্গিদের মূলোৎপাটন করতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে জঙ্গি দমনে সফলতাও দেখিয়েছে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা কিছু জঙ্গি বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের হুজি নেতাদের হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে। এই অর্থের একটি বড় অংশ আগে কারাবন্দী জঙ্গি নেতা ও নিহত জঙ্গি পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হতো। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এখন ওই অর্থ নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র। সূত্র আরও জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অর্থের পাশাপাশি জঙ্গিরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যও পাঠাচ্ছে এ দেশে। বিনিময়ে হুন্ডির মাধ্যমে অজস্র অর্থ চলে যাচ্ছে এ দেশ থেকে। আবার এসব অস্ত্রশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। এ কাজে একশ্রেণির চোরাকারবারি জড়িত বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে। সম্প্রতি কিছু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও পুলিশ সদস্য সিন্ডিকেট করে এজেন্ট ও সাব-এজেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ও সীমান্তের চেকপোস্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকাসহ কিছু এলাকার বাণিজ্যিক ব্যাংক, কুরিয়ার সার্ভিস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং ইমিগ্রেশনের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এমনকি ইমিগ্রেশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধীরাও এ কাজে জড়িত বলে জানা গেছে। শুধু তা-ই নয়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের হাত করে ভুয়া রপ্তানি বিল পরিশোধের মাধ্যমেও অবৈধ অর্থ বাংলাদেশে ঢুকছে, যা বিভিন্নজনের হাত ঘুরে জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে টাকার মালিক ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোপন সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের এই সদস্যরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে বাংলাদেশে অবৈধ পথে অর্থ পাঠাচ্ছে, যার একটা বড় অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য কেনার কাজে। এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আসন্ন নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকারের শীর্ষ মহল। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। জঙ্গি অর্থায়নে জড়িতদের ঠেকাতে প্রয়োজনে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় র্যাব-বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে এই অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যেতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করতে এবং সদস্যদের খরচ মেটাতে দেশের বাইরে অবস্থানকারী জঙ্গিরাই অর্থ পাঠাচ্ছে। এর সঙ্গে কারা কারা জড়িত তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে তদন্ত করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপ-পরিচালক মুহিবুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন কেন্দ্র জঙ্গি অর্থায়নের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে যেন কেউ অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে, আমরা সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছি।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করছি।’