শিরোনাম
বুধবার, ১২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধনী দেশের গরিব সরকার বিপাকে

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে

পাহাড় আর ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি বেষ্টিত রাজধানী বৈরুতের রাস্তায় বিশে^র দামি সব ব্র্যান্ডের গাড়ির ছড়াছড়ি। শহরের এখানে সেখানে তাদের বিশাল শোরুম। শুধু টয়োটাই খুব একটা চোখে পড়ল না। প্রতি পরিবারে একাধিক গাড়ি। ফলে ঘরবাড়ির পার্কিং লট ছাপিয়ে রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে। দেখে মনে হতে পারে যেন ঢাকার রাজপথ। কিন্তু পরিপাটি ফুটপাথে হাঁটার লোক নেই। একাধিকবার যুদ্ধের কবলে পড়া লেবাননের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি পর্যটন। প্রায় ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ৪০ লাখ মানুষের বাস। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির। ফলে পর্যটনের পর রেমিট্যান্স তাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম একটি খাত। মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ডলারের বেশি। সামারে লাখ লাখ পর্যটকের কোলাহলে মুখর থাকে লেবাননের পথঘাট। ইউরোপীয় পর্যটকরা দলবেঁধে আসে এখানে। আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা। আসে আরবের বিভিন্ন পর্যায়ের শেখরা। তারা লেবাননজুড়ে অসংখ্য নিজস্ব প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন। বছরে একাধিকবার এসে সেসব প্রাসাদে আনন্দময় সময় কাটান। ভাষাগত নৈকট্য এর একটা বড় কারণ। লেবাননের সরকারি ভাষা আরবি, এ ছাড়া ফ্রেন্স, ইংরেজিও চলে সমানতালে। এখানে তাদের অবকাশ কাটানোর সঙ্গী হিসেবে অনিন্দ্য সুন্দর লেবানিজ তরুণীদের সঙ্গ পান তারা। এ জন্য অকাতরে ডলার ঢালতেও কার্পণ্য নেই আরব শেখদের। প্রাচুর্যের কারণেই বিশে^র প্রায় সব বিখ্যাত দামি ব্র্যান্ডের পণ্য ও সেবা সামগ্রীর শোরুম রয়েছে বৈরুত শহরজুড়ে। কিন্তু ধনাঢ্য মানুষের এই দেশে সরকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। গত কয়েক বছরে টাকার অভাবে সরকার কোনো কিছুই করতে পারছে না। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও নিয়মিত দিতে পারছে না। অথচ এদেশের ব্যাংকিং খাতের রমরমা অবস্থা। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের ধনাঢ্যরা তাদের কালো টাকা সাদা করে লেবানিজ ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু লেবানন সরকার বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগের কার্যকর হিস্যা পায় না না। কারণ, দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের শক্ত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা তেমন ট্যাক্স দেয় না। সরকারি কোষাগার তাই চলছে টানাটানিতে। নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত মাসে কর্মচারীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু আন্দোলনের মুখে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গত বছরের শুরুতে দেশে নির্বাচনের পর নিজেদের রাজনৈতিক বিরোধে প্রায় ১০ মাস সরকার গঠন করতে পারেনি তারা। তিন মাস আগে নতুন সরকার ঘোষণা হলেও সরকারের অংশীদার খ্রিস্টান, শিয়া, সুন্নি এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে বিরোধ কমছে না।

এমন পরিস্থিতিতে নতুন খাতে বিনিয়োগ করতে পারছে না সরকার। দুই বছরের মাথায় লেবানন এসে সরকারের এমন বেহাল অবস্থা দেখব ভাবিনি। সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মসূচির মধ্যে আমরা যাই লেবাননের নৌবাহিনী সদর দফতরে। ছোট্ট তিনতলা ভবনের মধ্যে তাদের নেভাল হেডকোয়ার্টার। একটি দেশের নৌবাহিনীর এমন জীর্ণ সদর দফতর হতে পারে সেটা চিন্তায় ছিল না। রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ থানা ভবনও এটির চেয়ে জৌলুসপূর্ণ। শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডিঙিয়ে দোতলায় উঠে দেখি দুই লাস্যময়ী লেবানিজ নারী কর্মকর্তা করপোরেট কালচারের ভঙ্গিতে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। লেবানন নৌবাহিনীর সম্পদ বলতে হাতেগোনা কয়েকটি ছোট আকৃতির জীর্ণ জাহাজ। জাতিসংঘের মেরিটাইম টাস্কফোর্সের আওতায় বাংলাদেশসহ বিশে^র ছয়টি দেশের যুদ্ধজাহাজ লেবাননের সমুদ্রসীমায় চোরাচালান রোধ, অনাকাক্সিক্ষত জাহাজ চিহ্নিত করাসহ বিভিন্নভাবে লেবাননকে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নিজেদের সদর দফতরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিনিধি দলকে কাছে পেয়ে খুশি লেবানিজ নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল হোসনি দাহের। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের বন্দরের নিরাপত্তা, নেভি সদস্যদের প্রশিক্ষণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ রোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। লেবানিজ নৌ প্রধানের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিনিধি দলনেতা কমোডর মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ডগুলোতে বিশ্বমানের যুদ্ধজাহাজ তৈরি হয়। লেবানন নৌবাহিনী চাইলে বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে পারে। জবাবে লেবাননের নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল হোসনি দাহের বলেন, আমাদের বাজেটের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও আমরা বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখলাম। বাংলাদেশ নৌবাহিনী যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে লেবাননের সমুদ্রপথ পাহারা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের কাছে নতুন ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। এ জন্য লেবাননের সরকারও বাংলাদেশকে সমীহের চোখে দেখে। দীর্ঘ নয় বছরের ধারাবাহিকতায় লেবাননে বর্তমানে কাজ করছে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস বিজয়। লেবাননের বিভিন্ন দুর্যোগে সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। শীত মৌসুমে লেবাননে প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকে দুর্যোগময়। এ সময় সাধারণ জলসীমার নিরাপত্তা বলতে কিছুই থাকে না। উত্তাল সাগর নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। সেই দুর্যোগে ইউনিফিলে অংশ নেওয়া উন্নত দেশের নৌবাহিনী নিরাপদে আশ্রয়ে চলে গেলেও দায়িত্ব অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। দুর্যোগে ভূমধ্যসাগরে নিয়মিত টহল দিয়ে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে নৌবাহিনীর সদস্যরা। সারা বছর এক দিনের জন্যও নৌবাহিনীর জাহাজের অপারেশন বন্ধ হয় না। এ জন্য বাংলাদেশের প্রতি লেবানন সরকার ও জাতিসংঘের অনেক বেশি নিভর্রতা। জাতিসংঘের পাশাপাশি লেবানন সরকারও বাংলাদেশ  নৌবাহিনীর কার্যক্রমে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

সর্বশেষ খবর