শিরোনাম
শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিবাহ বিচ্ছেদে নারীরা তিনগুণ এগিয়ে

রাজধানীতে প্রতিদিন ২৬ আবেদন, আপস চান ৫ শতাংশ দম্পতি

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি হারে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে আবেদন করছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যে এমনটি জানা গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে (১৮১ দিন) ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট চার হাজার ৫৫৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। অর্থাৎ ১৮১ দিনের হিসাব অনুযায়ী এক দিনে ঢাকার বিবাহিত নর-নারীর পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ২৬টি আবেদন করা হয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে বিচ্ছেদের আবেদন করার পর মাত্র পাঁচ শতাংশ দম্পতি বিচ্ছেদে না গিয়ে পুনরায় সংসার করার বিষয়ে একমত হচ্ছেন।

এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণে বিচ্ছেদের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই নারীদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটির গুলশান ও বনানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারী আর দক্ষিণের মোহাম্মদপুর ও কারওয়ান বাজারের কর্মজীবী নারীরা তুলনামূলক বেশি বিচ্ছেদে যেতে চাচ্ছেন। বিগত ছয় মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পাঁচটি অঞ্চলে তালাকের আবেদন এসেছে ২ হাজার ৩১৫টি। এর মধ্যে অঞ্চল-১ এ আবেদনকারীর সংখ্যা ২৮৩ (নারী ১৫৫ ও পুরুষ ১২৮ জন), অঞ্চল-২ এ ৫০০ (নারী ৩৭২ ও পুরুষ ১৭৭ জন), অঞ্চল-৩ এ ৫২৩ (নারী ৩৪৩ ও পুরুষ ১৮০ জন), অঞ্চল-৪ এ ৩৭৭ (নারী ২৭৯ ও পুরুষ ৯৪), অঞ্চল-৫ এ ৬৩২ (নারী ৫০৭ ও পুরুষ ১২৫)। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন ২ হাজার ২৪২ জন মানুষ। এর মধ্যে অঞ্চল-১ এ আবেদনকারীর সংখ্যা ২৫০ (নারী ১৫২ ও পুরুষ ৫৮ জন), অঞ্চল-২ এ ৫৮৪ (নারী ৪০০ ও পুরুষ ১৮৪ জন), অঞ্চল-৩ এ ৪৮৯ (নারী ৩৮৮ ও পুরুষ ১০১ জন), অঞ্চল-৪ এ ১৫৭ (নারী ১১১ ও পুরুষ ৪৪), অঞ্চল-৫ এ ৭৬২ (নারী ৫৭২ ও পুরুষ ১৯০)।

আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারীরা বর্তমানে ঝুঁকিতে আছেন। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি হাজারে ১০.৮ শতাংশ নারী বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন। এর বিপরীতে প্রতি হাজারে ১.৫ শতাংশ পুরুষ বিচ্ছেদ করেছেন। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করার পেছনে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের বনিবনা না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি প্রধান কারণ। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে রয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা ইত্যাদি। তবে বর্তমানে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারী-পুরুষরা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন একে অপরকে বিশ্বাস করেন না। আর এর পেছনে সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার দায়ী। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষিত দম্পতিদেও ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করার কারণে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে বিবাহ বিচ্ছেদে। তবে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির দম্পতিদের ক্ষেত্রে সাংসারিক মনোমালিন্য, কিছু ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে রেখে আরেকটি বিয়ে করায় সেই নারী বিবাহ বিচ্ছেদ চান। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় রাজধানীতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এরপরও এই সংস্থার পক্ষ থেকে ‘কেন এত বিপুল সংখ্যায় নর-নারী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন’ বা এসব প্রতিরোধের জন্য কোনো গবেষণা সেল গঠন করা হয়নি। তাদের মতে, দেশের বিভিন্ন বেসরকারি এনজিওগুলো যদি এ বিষয়ে গবেষণা করে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ তুলে ধরে- তবে তা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। ঢাকা উত্তর সিটির আইন কর্মকর্তা নাজমুল হুদা শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করার তিন মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ শালিসি বৈঠকের ব্যবস্থা করে। কিন্তু যারা আগে থেকেই বিচ্ছেদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন- তারা এই বৈঠকে আসেন না। যেহেতু এই বৈঠকে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক নয়- এ জন্যও অনেকে আসেন না। তবে একটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য তিন মাস যথেষ্ট সময়। বিশেষ করে সন্তানের কথা ভেবে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ যাবেন না বলেও সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চল-৫ এর নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) মোহাম্মদ সামছুল হক বলেন, সমাজ যত উন্নত হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন তত শিথিল হচ্ছে। আমাদের কাছে যারা বিচ্ছেদের আবেদন করছেন তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ আপসে যেতে রাজি হন। বিগত সময়ের তুলনায় দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, আর এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিচ্ছেদের আবেদন করছেন নারীরা। বিবিএস-এর সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ঢাকার তুলনায় অন্য বিভাগীয় অঞ্চল ও জেলাশহরগুলোতে নারী-পুরুষদের বিবাহ বিচ্ছেদের হার ও আশঙ্কা উভয়ই বেশি। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, গ্রামের দম্পতিরা শহরের দম্পতিদের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রাজশাহী এলাকার মানুষ (প্রতি হাজারে ১.৭ শতাংশ হারে) বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এরপর বিচ্ছেদেও ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে খুলনা (প্রতি হাজারে ১.৪ শতাংশ)। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিবাহ বিচ্ছেদের হার দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় কম (প্রতি হাজারে তা ০.৫ শতাংশ)। দেখা যাচ্ছে যে, ২৫ থেকে শুরু করে ২৯ বছর বয়সী নারী-পুরুষরা সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন।

সর্বশেষ খবর