বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চেনা বন্ধুর অচেনা রূপ

মির্জা মেহেদী তমাল

চেনা বন্ধুর অচেনা রূপ

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বখতিয়ারের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এক ছাত্রীর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ওই ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের পর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে তারা। ছাত্রীটি তার ওপর দুর্বল হয়ে পড়ে বেশি। সুযোগ নেয় বখতিয়ার। শুরু হয় তার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। বখতিয়ারের কথায় নিজেই নিজের নগ্ন ছবি তোলে ছাত্রী। সেটি বখতিয়ারকে দেয়। কিন্তু ওই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখায় বখতিয়ার। মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। হতবাক ছাত্রী। এত কাছের চেনা পরিচিত বন্ধুটি তাকে কী বলছে? প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু টাকার জন্য যখন চাপ দিচ্ছিল অবিরাম, তখনই বুঝতে পারে, চেনা বন্ধুটি তার প্রকৃত বন্ধু নয়। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলার। ছাত্রীর কাছ থেকে নানা সময়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিতে থাকে। স্বর্ণালঙ্কারও নিয়েছে। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ছাত্রীটি। অভিভাবককে জানায়। অভিযোগ করা হয় পুলিশে। মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বখতিয়ারকে আটক করে পুলিশ। তার ল্যাপটপ থেকে এ রকম একাধিক মেয়ের নগ্ন ছবি উদ্ধার করা হয়।

যশোরের বকচর এলাকার এক গৃহবধূ (২৮) আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে পুলিশ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা খুঁজে পায়। এ ঘটনায় পুলিশ গ্রেফতার করে গৃহবধূর ভাগ্নিজামাই টিটু শেখকে। টিটু পুলিশকে জানিয়েছেন, মাথাব্যথার ওষুধের কথা বলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেন তার মামিকে। মামি ঘুমিয়ে পড়লে গোপনে তিনি তার কাপড় খুলে নানাভাবে ছবি তোলেন। পরে সেই ছবি দেখিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করেন। টিটু ওই পর্নো ভিডিও দেখিয়ে দৈহিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন। অব্যাহত ব্ল্যাকমেইলিংয়ে একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন মামিশাশুড়ি। কিন্তু টিটু দৈহিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে ওই পর্নো ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে বলে হুমকি দেন। এর পরই তার মামি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর রাজধানীর মগবাজারের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয় সামিয়ার (ছদ্মনাম)। আগে থেকেই ফেসবুকে তার একটি অ্যাকাউন্ট ছিল। বিয়ের এক সপ্তাহ পর কে বা কারা মেয়েটির নামে আরেকটি অ্যাকাউন্ট খুলে নানা ধরনের অশ্লীল ছবি পোস্ট শুরু করে। পরিচিতদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে মেয়েটি মুষড়ে পড়েন। ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় সংসার। পরে পুলিশকে জানালে পুলিশ সেই ফেক আইডির মালিককে গ্রেফতার করে। সেই ফেক আইডি চালাত মেয়েটির বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু। নানাভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে মানুষ। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে নারী শিকার হচ্ছে এমন অসংখ্য সাইবার ক্রাইমের। যার একটি বড় অংশই প্রকাশ্যে আসে না। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ অন্য মাধ্যমগুলোয় এ অপরাধের প্রবণতা বেশি। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। প্রতিশোধ নিতে কেউ আবার নিজেই অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্ল্যাকমেইলিং শিকার হচ্ছে মূলত কাছের লোকজনের মাধ্যমেই। কেউ একসময় অচেনা ছিল, ফেসবুকের কারণে চেনা হয়ে যায়। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। সাইবার অপরাধের শিকার ৪৪ শতাংশই মনে করেন, সাইবার অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়া গেলে দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাকিদের মধ্যে ২৯ শতাংশের পরামর্শ হলো, আইনের প্রয়োগ বাড়ানো। ২৭ শতাংশ সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ আইনি সহায়তা নেয় না। এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক; যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১৫ ভাগ। এর বিশাল অংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী। তবে অসচেতনতার কারণে সম্প্রতি এ মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে এর একটি বড় অংশ সহজেই দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে সাইবার হামলার শিকার হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। একই ধরনের অপরাধের শিকার হয় ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘মেয়েরা ফেসবুকে কে আসল কে নকল তা যাচাই-বাছাই না করে খুব বেশি খোলামেলাভাবে ভার্চুয়ালি মিশে থাকে। এভাবেই একটু একটু করে তারা ফাঁদে পা দেয়। একজন টিনএজার গার্মেন্ট কর্মীও আজকাল স্মার্টফোন, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। অথচ ফেসবুকের সিকিউরিটি বা প্রাইভেসির বিষয়ে সে কিন্তু মোটেও সচেতন নয়। একই সঙ্গে বাবা-মা এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে তাদের সন্তান কী করছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখেন না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও অতি আহ্লাদের জায়গা থেকে সন্তানদের হাতে এ বয়সেই একটি আইফোন ধরিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হন। অথচ ১৮ বছর বয়সের নিচে সন্তানের হাতে যে ফোন দেওয়া ঠিক নয় তা তারা একবারও ভেবে দেখেন না।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর