শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুখোশে ঢাকা

মির্জা মেহেদী তমাল

মুখোশে ঢাকা

একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রুমানা (ছদ্মনাম)। এক সকালে কলেজ অধ্যক্ষ তাকে নিজ রুমে ডেকে পাঠান। রুমানা অধ্যক্ষের রুমে গিয়ে চেয়ারে বসেন। তাকে কোকা কোলা খেতে দেন অধ্যক্ষ। তার লেখাপড়ার খোঁজখবর নেন। কোনো সমস্যা থাকলে তাকে যেন সরাসরি বলে। এ ধরনের নানা পরামর্শ দিতে থাকেন অধ্যক্ষ। এক সময় ছাত্রীটি অচেতন হয়ে পড়েন। তার জ্ঞান যখন ফিরে আসে, রুমানা নিজেকে স্যারের রুমের সোফাসেটের ওপর শোয়া অবস্থায় দেখতে পান। শরীরে কোনো কাপড় নেই। পাশেই বসা রয়েছেন অধ্যক্ষ। তার হাত ছাত্রীর শরীরের ওপর। এ অবস্থায় নিজেকে পেয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করে রুমানা। কিন্তু মুখ চেপে ধরেন অধ্যক্ষ। বলেন, চিৎকারে লাভ হবে না। এতে তোমার ক্ষতি হবে। ভিডিও করে রেখেছি সব। ইন্টারনেটে ছেড়ে দেব।

ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটি রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের। কলেজের সেই অধ্যক্ষ এ কে এম রেজাউল করিম রতন এখন কারাগারে। ঘটনার শুরু ২০১৬। সেই বছরের জুনেই রুমানা মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ভর্তির প্রক্রিয়া চলার সময় রতন তার সঙ্গে কথা বলেন এবং ফোন নম্বর নেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ফোন করে তার (ছাত্রী) খোঁজখবর নিতে থাকেন। ২০১৭ সালে ওই ছাত্রীকে কলেজে তার (অধ্যক্ষ) কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন।

এ কে এম রেজাউল করিম রতন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। গত বছর কোটায় উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গ্রন্থাগার অধিদফতরের উপসচিব (সাময়িক বরখাস্ত) হিসেবে কর্মরত। এর আগে মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের ছাত্রীর করা আরেক মামলায় তাকে গ্রেফতার করে হাজারীবাগ থানা পুলিশ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত রবিবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে বিচারক জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন রেজাউল করিম রতন। রতনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের সূত্রগুলো জানায়, এক ছাত্রীই শুধু নয়, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের আরও কয়েক ছাত্রী রতনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছে। যৌন নির্যাতনের শিকার ছাত্রীরা যদি প্রথমেই প্রতিবাদ করতেন, তাহলে পরে আর কোনো শিক্ষার্থী এমন নির্যাতনের শিকার হতেন না। হয়রানির প্রতিবাদ করায় ক্ষুব্ধ রতন রুমানাকে মারধর করেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর রুমানার বাসায় গিয়ে শাসায়। এ সময় স্থানীয় লোকজন ওই বাসায় গিয়ে রতনকে আটকিয়ে পুলিশে দেয়। পুলিশ জানায়, ‘গত শনিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর রতনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তিনি বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করার বিষয়ে স্বীকার করেন। একপর্যায়ে তার কাছে (রতন) জানতে চাওয়া হয় বিয়ে না করে কেন এসব সম্পর্ক করেছেন। এর জবাবে তিনি বলেন, বিয়ে হয়নি, তবে হবে। অনৈতিক বলে কিছু নেই।’ রতনের নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরে মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের ওই ছাত্রী বলেন, ‘তিনি প্রথমে শিক্ষক হিসেবে কথা বলেন। পরে ছাত্রীদের দুর্বল দিকগুলো জানার চেষ্টা করেন। ছাত্রীদের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে কৌশলে তিনি সম্পর্ক স্থাপন করেন। দুর্বল কিছু মুহূর্তের ভিডিও করে রেখে সেগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি পরে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করেন।’ ধানমন্ডি থানার একজন পরিদর্শক জানান, উপসচিব রতন মামলার বিষয়ে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি আগে প্রভাবশালী ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। ওই সুবাদে পুলিশ ও জনপ্রশাসনে বহু কর্মকর্তা তার পূর্বপরিচিত। তাদের দিয়ে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি পুলিশের বিরুদ্ধে তার কাছে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবিরও অভিযোগ তোলেন। ধানমন্ডি থানা পুলিশ রতনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাটির তদন্তভার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠায়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তদন্ত কর্মকর্তা রতনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। পরে ওই মামলায় রতনকে জামিন দেয় আদালত। রেজাউল করিম রতনের শাস্তি দাবি করে গত জুলাই মাসের শুরুর দিকে আন্দোলন শুরু করে মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা কয়েক দফায় সড়ক অবরোধ করেন এবং রতনের ফাঁসিসহ ৬ দফা দাবি জানান। ছাত্রছাত্রীদের দাবির মধ্যে আরও ছিল, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নিরাপত্তা প্রদান, ধর্ষণ মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- প্রদান, কোনো প্রকার জামিন মঞ্জুর না করা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে রতনকে সাময়িক বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর রতন মামলার বাদী ওই ছাত্রীর ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হন। রতনসহ কয়েকজন মিলে হাজারীবাগ এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় ওই ছাত্রীর ওপর হামলা চালান ও মারধর করেন। যার কারণে ৭ অক্টোবর মামলাটি করা হয়। এই মামলার পর গত ১০ অক্টোবর রতন পুনরায় ওই ছাত্রীর বাসায় যান। এ সময় এলাকার লোকজন রতনকে অনুসরণ করে এবং আটক করে। হাজারীবাগ থানার মামলায় শনিবার রাতে রতনকে গ্রেফতার করে হাজারীবাগ থানা পুলিশ। রবিবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর