শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নিষ্পাপ চেহারার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণা বাবা-ছেলের

মাহবুব মমতাজী

নিষ্পাপ চেহারার আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারণায় লিপ্ত গোলাম মোস্তফা আদর ও তার বাবা গোলাম মোহাম্মদ কালু। সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য দেখিয়ে প্রতারণা করা বাবা-ছেলের যেন ডাল-ভাত। ২০ বছর বয়সেই আদরের হাতেখড়ি প্রতারণায়। তার প্রথম শিকার আপন ফুফাতো ভাই। নিলামের বাড়ি ও জায়গা কিনে দেওয়া, ডলার এবং লটারির ব্যবসার নাম করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। এ ঘটনা ২০১২ সালের। আজও টাকা ফেরত পায়নি স্বজনরা। তাদের দ্বারা একজন পুলিশ সুপার প্রতারণার শিকার হতেই শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। এমনকি আদর ও তার বাবার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে করা মামলার তথ্যও পাওয়া যায়।

গত ২৮ আগস্ট গোলাম মোস্তফা আদর ও তার বাবা গোলাম মোহাম্মদ কালুকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একই সঙ্গে তাদের গাড়িচালক দুলালকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।  ডিবি পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, তাদের সঙ্গে আসলে কারোরই কোনো সম্পর্ক নেই। এরা একটি নেটওয়ার্ক বজায় রেখে ভুক্তভোগীদের দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। এরপর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। ১২ বছর ধরে বাবা-ছেলের বৈধ কোনো উপার্জন নেই। অথচ থাকেন উত্তরা, গুলশান ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার দামি ফ্ল্যাটে। চলাচল করেন প্রিমিও গাড়িতে, খাবার নেন ফুডপান্ডা থেকে। তাদের অবৈধ অর্থের উৎস এক জমি একাধিকবার বিক্রি, অর্থমন্ত্রী এবং তার মেয়ের পরিচয়ে ঋণ জালিয়াতি করা, বর্তমান ও সাবেক আইজিপিদের আত্মীয়, স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর বন্ধু পরিচয়ে গ্রেফতারদের মুক্ত করা অথবা জামিনে বের করার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এমনকি জেলহাজতে আটক ব্যক্তিদের স্ত্রী অথবা কম বয়সী মেয়েদের সেক্সুয়ালি এক্সপ্লইট করে ছবি বা ভিডিও ধারণ করেও ব্ল্যাকমেইলিং করত প্রতারক আদর। এমন শত শত অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। কিছু ফোনালাপেও মেলে তার সত্যতা। হঠাৎ এক দিন রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশ সুপার বেলায়েতের কাছে ফোন করেন আদর। তার বদলির আবেদনের দিন-তারিখ এবং কোথায় আবেদন জমা দিয়েছেন সব বলেন। এ খবর জানানোর পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাবা গোলাম মোহাম্মদ কালুর সাক্ষাতের কয়েকটি ছবিও পাঠান। দ্রুত তার বদলির আশ্বাসও দেন। সবকিছুর মিল পেয়ে আশ্বস্ত হন বেলায়েত। এভাবে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এক দিন অসুস্থতার কথা বলে বেলায়েতের কাছে ১০ লাখ টাকা ধার চান আদর।

মানবিক কারণ ও বদলির আশায় ৫ লাখ টাকা আদরকে চেকের মাধ্যমে ধার দেন। কয়েক দিন পর পল্টি মারেন আদর। নানা কারণ দেখিয়ে টাকা ফেরত না দেওয়ার বাহানা শুরু করেন। গত বছরের ৭ নভেম্বর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু। একই বছরের ১৯ অক্টোবর গ্রেফতার হন উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এই দুই সাবেক কাউন্সিলরকে জামিনে বের করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে হাতিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা। ময়নুল হকের স্ত্রী জাহানারা বেগম রেখা বলেন, আমাকে প্রথমে বলেছে যে ৮ লাখ টাকা লাগবে সাত দিনের মধ্যে তাকে বের করে দেব। পরে বলে ৩০ লাখ টাকা লাগবে, দরকার হলে তারা আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। আপনি এখন ১৫ লাখ দেন বাকিটা আমরা দিয়ে দেব। এভাবে মোট সাড়ে ১১ লাখ টাকা নিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর মেয়েকে দিয়ে তদবির করে ১০ কোটি টাকা লোনের ব্যবস্থার আশ্বাস দেন এক ব্যবসায়ীকে। মৃণাল বাবু নামে ওই ব্যবসায়ীর ৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। একইভাবে লোন পাসের আশ্বাসে আদরকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেন গোলাম জিলানী নামে আরেক ব্যবসায়ী। ডিবির তদন্তে জানা যায়, ২০১৫ সালে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র আসিফ-ইমরানকে অপহরণ করে মুক্তিপণ না দেওয়ায় খুন করা হয়। লাশ মেলে বুড়িগঙ্গায়। মামলায় প্রধান আসামি হন আদর ও তার বাবা। গ্রেফতারও করা হয় তাদের, স্বীকারোক্তিও দেন। ওই মামলায় এখন তারা জামিনে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর