শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বে-টার্মিনাল প্রকল্পে ধীরগতি

এখনো সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়নি

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বে-টার্মিনাল প্রকল্পে ধীরগতি

বাস্তবায়নের আগেই ‘আজ এবং আগামীর বন্দর’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। দেশের আমদানি-রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে পতেঙ্গা-হালিশহরের সাগর উপকূলজুড়ে ‘বে-টার্মিনাল’ গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এর নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত দুই বছরে এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিজ (সম্ভাব্যতা যাচাই) কাজও সম্পন্ন হয়নি। দুই মাস আগে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলেও দাফতরিক কাজের জন্য তাকে এখনো দেওয়া হয়নি কোনো দফতর বা অফিস। প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে হওয়ার কথা রয়েছে। তাই আগামী সেপ্টেম্বরের দিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আগ্রহী বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এর পরই মূল কাজ শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০ কোটি ডলার প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্য পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ) ও সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে (আরএসজিটি) সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, নগরের পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় সাগর উপকূলের ৮৭১ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সরকারি জমি ছাড়াও সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা আরও ১ হাজার ৬০০ একরসহ ২ হাজার ৫০০ একর জমিতে টার্মিনালটি নির্মাণের  কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৮ একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের অবশিষ্ট ৮০৩ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমতি মিলেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। তবে এ কাজে তেমন গতি নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোর চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বড় প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের বর্তমান অবকাঠামো ৪৫০ একর জমির ওপর। এ বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার গভীরতা ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না। বে টার্মিনাল হলে ভিড়তে পারবে ১২ মিটার গভীরতা ও ২৮০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে জাহাজ। ফলে বন্দরে প্রতি বছর যে পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং হচ্ছে, বে-টার্মিনালে হ্যান্ডলিং হবে এর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। এখন বন্দরে জোয়ার-ভাটার ওপর ভিত্তি করে জাহাজগুলো জেটিতে ভেড়ে; আর মাদার ভ্যাসেলগুলোকে বহির্নোঙরে অবস্থান করতে হয়। বে-টার্মিনালে দিনে-রাতে জাহাজ জেটিতে ভিড়তে এবং ছেড়ে যেতে পারবে জাহাজ ও মাদার ভ্যাসেল। এতে পণ্য পরিবহন খরচ ও বিপুল সময় সাশ্রয় হবে।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বে-টার্মিনাল অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন ব্যবহারকারীরা। চট্টগ্রাম বন্দরে গত বছর ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৭ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। একই সঙ্গে এ বন্দর ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩৬ টন পণ্য হ্যান্ডলিং করে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ৬.৩৪ শতাংশ। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর জাহাজ হ্যান্ডলিং করে ৩ হাজার ৮০৭টি। অন্যদিকে চলতি বছর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অন্তত ৩৪ লাখ টিইইউএস কনটেইনার, সাড়ে ১১ কোটি টন খোলা পণ্য এবং পাঁচ হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই প্রকল্পে নতুন করে ডিটেইল ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য কনসালটেন্ট নিয়োগ চলছে, যেখানে আর্থিক ব্যয়ের বিষয়টিও যুক্ত থাকবে। ছয় মাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আমরা বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে ট্রাক টার্মিনাল এবং কনটেইনার রাখার ইয়ার্ড নির্মাণ করব। ফলে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালুর পর সক্ষমতা শেষ হওয়ার আগেই আমরা এই টার্মিনাল ও ইয়ার্ড পেয়ে যাব। এর জন্য ৬৮ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন বন্দরকে বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ইয়ার্ড, ট্রাক টার্মিনাল ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ কিছুটা শুরুও হয়েছে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন না হলে বিপাকে পড়তে হবে আমাদের। ভূমিসহ সব ধরনের জটিলতা দূর করে সরকারকে প্রকল্পটির জন্য আরও আন্তরিক হতে হবে।’

ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা : ২০১৪ সালে বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় ভূমি বরাদ্দের জন্য যে আবেদন বন্দর কর্তৃপক্ষ করেছিল, তা যথাযথ ছিল না। এই ভূমি বরাদ্দ দিতে গিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় দেখতে পায়, ২৪ বছর আগে (১৯৯৬-৯৭ সালে) সাগরের উপকূলের এসব খাসজমি জেলা প্রশাসন ৫০টি ব্লকে ভাগ করে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। আর লিজ দেওয়া জমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ দেওয়া যায় না, অধিগ্রহণের মাধ্যমে বরাদ্দ নিতে হয়। বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় ৮২০ একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয় বলে পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় দফায় ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দের জন্য আবেদন করে।

বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বে-টার্মিনাল নিয়ে একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা, অর্থাৎ একটি মাস্টারপ্ল্যান করার প্রয়োজন ছিল। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর সেই মাস্টারপ্ল্যান বা পরিপূর্ণ স্টাডির কাজটি একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৈরি করত। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণসহ পুরো বে-টার্মিনালের সামগ্রিক কাজ করা হতো। কিন্তু সেই স্টাডি তো হয়নি। আমি এখন সেই স্টাডি করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিচ্ছি। সব চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হবে।’

তিনি বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের স্টাডি রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণে অর্থায়ন কে করবে এবং টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম বলেন, বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় লেগে যাবে। এটি সরকার চাইলেও ফাস্ট ট্র্যাকে আনতে পারবে না। কারণ এটা পিপিপির মাধ্যমে করার পরিকল্পনা হয়েছে। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাদের ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করে লগ্নি করা অর্থ কীভাবে উঠে আসবে সব জেনেই তারপর কাজে হাত দেবে। ফলে এটি সরকারের বা বন্দর কর্তৃপক্ষের একক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না।

প্রকল্প পরিচারক মো. ইলিয়াছ রেজা জানান, দুই মাস আগে পায়রা বন্দর থেকে এনে তাকে বে-টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই মাসেও তার জন্য নির্দিষ্ট কার্যালয় বা দফতর বরাদ্দ না দেওয়ায় তিনি প্রকল্পটি সম্পর্কে তেমন খোঁজখবর নিতে পারেননি। তাই প্রকল্প নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

সর্বশেষ খবর