রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ট্রলিবোমায় যুবকের খণ্ডিত লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ট্রলিবোমায় যুবকের খণ্ডিত লাশ

ময়মনসিংহ শহরের পাটগুদাম ব্রিজ এলাকা। একটি লাল রঙের ট্রলিব্যাগ পড়ে আছে। দাবিদার নেই। লোকজনের কৌত‚হল সেই ট্রলিব্যাগ ঘিরে। ব্যাগটির সামনে কেউ যাচ্ছে না। দূর থেকে দেখছে সবাই। প্রচন্ড ভিড় সেখানে। একেকজন একেক ধরনের কথা বলছে। কেউ বলছে ব্যাগের ভিতর অবৈধ মাল। কেউ বলছে ডাকাত দলের লুটে নেওয়া মালের মধ্যে ব্যাগটি ফেলে গেছে। আবার কেউ বলছে এসব কিছু না। এটি ট্রলিবোমা। সন্ত্রাসীদের কাজ হতে পারে। সব ছাপিয়ে ব্যাগটির পরিচয় হয়ে গেছে ‘ট্রলিবোমা’। বোমার খবরটি মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ল। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন বিপদমুক্ত দূরত্ব বজায় রেখে ‘ট্রলিবোমা’ দেখছে। সংবাদ পেয়ে আসে পুলিশ। পুলিশেরও ধারণা এটি শক্তিশালী ‘ট্রলিবোমা’। যে কোনো সময় এটি ভয়ংকরভাবে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। পুলিশ হ্যান্ডমাইক দিয়ে লোকজনকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। খবর দেওয়া হয় বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিটকে। কিন্তু ঢাকা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে সময় লাগবে একটু। ততক্ষণে পুলিশ ওই ‘ট্রলিবোমা’র চারদিকে বালুর বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। ট্রলিবোমার পাহারায় পুলিশ। আতঙ্কিত লোকজন নিজ নিজ বাসার দিকে ছুটতে থাকে। সে এক ভয়ংকর অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাত কাটে অজানা আশঙ্কায়। পরদিন সকালে ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট যায় ঘটনাস্থলে। তারা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিটের দুই সদস্য নির্ধারিত পোশাক পরে ধীরপায় এগিয়ে যেতে থাকে ট্রলিবোমার দিকে। পিনপতন নিস্তব্ধতা। উৎসুক জনতার দৃষ্টি তখন ট্রলিবোমার দিকে। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের দুই সদস্য ব্যাগটির সামনে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়েন। ব্যাগটির সঙ্গে এমন কিছু জড়ানো নেই, যাতে করে বোমা বলে মনে হবে। এরপরও দুই সদস্য ঘামতে থাকেন। তারা চেষ্টা করেন ট্রলিব্যাগটি খোলার। ধীরে ধীরে ব্যাগের চেইন খুলতে থাকেন। কোনো ধরনের সমস্যা হলো না। এরপর একটু থেমে টান দিয়ে পুরো চেইন খুলে ফেলেন। ভিতরে যা চোখে পড়ল তাদের, তাতে করে দুই কর্মকর্তা আঁতকে উঠলেন। বোমা না হলেও ভিতরে যা দেখলেন, তাতে করে শরীর তাদের কেঁপে ওঠে। এও কি সম্ভব! ব্যাগের ভিতরে মানুষের হাত, পা ও মাথাবিহীন একটি খন্ডিত লাশ (গলা হতে কোমর পর্যন্ত)! ট্রলিতে কোনো বোমা ছিল না। ছিল অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশের খন্ডিত অংশ। লাশটি কার! কোথা থেকে এলো? খন্ডিত অংশগুলোই বা কোথায়? এমন সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পুলিশ মাঠে নামে। ঘটনাটি ২১ অক্টোবরের। একই দিন কুড়িগ্রাম পুলিশ সদর থানার বেলগাছা এলাকায় একটি কাটা পা উদ্ধার করে। ঠিক তার পরের দিন কুড়িগ্রামের রাজাপুর থানায় একটি ব্যাগে আরেকটি কাটা পা ও দুটি হাত এবং অপর আরেকটি ভ্যানিটি ব্যাগে খন্ডিত মাথা উদ্ধার করে কুড়িগ্রাম পুলিশ। ময়মনসিংহে দেহ আর কুড়িগ্রামে খন্ডিত হাত-পা আর মাথার সন্ধান মেলে। পুলিশ মানবদেহের খন্ডিত অংশগুলো একজনের বলেই ধারণা করছে। কারণ, ময়মনসিংহ আর কুড়িগ্রামে পাওয়া লাশের সঙ্গে থাকা পলিথিন ব্যাগ আর কালো সুতা ছিল একই ধরনের। আর যদি তাই হয়, ক্লু-লেস এই খুনের ঘটনার তদন্তে পুলিশ অনেকটা এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ খন্ডিত অংশগুলো অন্তত একজনের বলে মিলেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা এমনটাই ভাবছেন। পরে সব খন্ডিত অংশের ডিএনএ টেস্ট করে পুলিশ মরদেহের সব খন্ডিত অংশ এক ব্যক্তিরই বলে নিশ্চিত হয়। পুলিশ বাদী হয়ে ২৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ  কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। কিন্তু আর কোনো সূত্র পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না। ময়মনসিংহ আর কুড়িগ্রাম। দুই জেলায় খন্ডিত দেহগুলো কারা নিল সেটি তাদের ভাবিয়ে তোলে। প্রাথমিক অবস্থায় লাশ শনাক্তকরণে এবং হত্যাকান্ডের রহস্যের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না দুই  জেলার পুলিশ সদস্যরা। এরপর ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ এ ঘটনার তদন্তে নামে।

তবে কুড়িগ্রাম পুলিশ খন্ডিত দেহ উদ্ধারের সময় ব্যাগের মধ্যে একটি চিরকুট খুঁজে পায়। সেখানে ছিল দুটি ফোন নম্বর। পাশাপাশি দুজনের নাম। পুলিশ এই চিরকুট নিয়েই তদন্তে এগিয়ে যেতে চায়। পুলিশ প্রথমে ফোন নম্বরে কল করে পায় তামিম নামে এক মেয়েকে। তামিম পুলিশকে জানায়, সে এই চিরকুটটি দিয়েছিল তার বান্ধবী জান্নাতকে। পুলিশ জান্নাতের খোঁজ পায় ধোবাউড়া উপজেলায়। জান্নাত পুলিশকে জানায়, চিরকুটটি তিনি রেখেছিলেন তার ভাই ফারুকের ব্যাগে। কিন্তু এই চিরকুটটি কীভাবে কুড়িগ্রামে গেল তা জান্নাত নিজেও বলতে পারেনি পুলিশকে। তার ভাই ফারুক কোথায় আছে, জানতে চাইলে জান্নাত বলে তার জানা নেই। গাজীপুর থাকার কথা। তবে সুনির্দিষ্টভাবে জানে না কোথায় আছে ফারুক। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় ফারুকের খোঁজে। কিন্তু কোথাও তাকে পায় না। পুলিশ নিশ্চিত যে, ফারুকের খোঁজ পেলে খুনের রহস্য খুঁজে পাওয়া যাবে। তাকে না পেয়ে পুলিশ ফিরে যায় আবার জান্নাতের কাছে। পুলিশকে জান্নাত জানায়, জুয়েল আর জাহিদ বলতে পারবে ফারুক কোথায় আছে। এরা দুজন ফারুকের বন্ধু। এ দুজনের সঙ্গে ফারুকের সব সময় যোগাযোগ থাকে। পুলিশ গাজীপুর যায় দুই বন্ধুর খোঁজ করতে।

ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা একটি চিরকুটের সূত্র ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় পুলিশ। এক পর্যায়ে পুলিশ নেত্রকোনার পূর্বধলা, ময়মনসিংহের তারাকান্দা ও গাজীপুরের বানিয়ারচালায় অভিযান চালিয়ে  মো. ফারুক মিয়া ও তার ভাই হৃদয় মিয়া, বোন সাবিনা আক্তার এবং ভাইয়ের বউ মৌসুমী আক্তারকে গ্রেফতার করে। তারা স্বীকার করে খুনের ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত। পুলিশ জানতে পারে হতভাগ্য ওই যুবকের নাম। তার নাম মো. বকুল (২৮)। তিনি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হুগলা গ্রামের ময়েজ উদ্দীনের  ছেলে ছিলেন। কেন খুন হলেন তা জানতে পারে পুলিশ। সাবিনাকে উত্ত্যক্ত করত বকুল। যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে দেওয়া হয়। জনৈক আবু সিদ্দিকের সঙ্গে সাবিনার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও বকুল তাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। এ নিয়ে এলাকায় সালিশ হয়। কোনো কাজ হয়নি। পরে সাবিনা তার দুই ভাই ফারুক আর হৃদয় এবং ভাবি মৌসুমীকে জানায়। তারা গাজীপুরে ফারুকের বাসায় বসে বকুলকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বকুলকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ফারুকের বাসায় নিয়ে আসা হয়। এরপর জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বকুলকে খাওয়ানো হয়। বকুল অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর তারা বকুলকে হত্যা করে ধারালো ব্লেড দিয়ে ছয় টুকরা করে। ট্রলিব্যাগটি নিয়ে যায় ফারুক আর হৃদয়। তারা সেটি ফেলে আসে ময়মনসিংহে। আর সাবিনা এবং মৌসুমী অন্য ব্যাগগুলো নিয়ে যায় কুড়িগ্রামে। সেখানে তারা ব্যাগটি ফেলে রেখে চলে আসে। পুলিশ জানায়, এরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে জয়দেবপুর থানার বানিয়ারচালা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় এই হত্যাকান্ড ঘটায়। এ ঘটনায় একটি ছুরি, নিহতের একটি মোবাইল ফোন, লাশের হাত-পা বহনকারী একটি কাপড়ের ব্যাগ এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি ইটের টুকরা আলামত হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সহোদর তিন ভাইবোন ও এক ভাবিকে গ্রেফতার করা হয়। এরা চারজনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর