বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

মালিকদের স্বার্থ দেখে না বিজিএমইএ

রুহুল আমিন রাসেল

মালিকদের স্বার্থ দেখে না বিজিএমইএ

পোশাকশিল্প মালিকদের স্বার্থ দেখছে না তাদেরই সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা। জানা গেছে, বিজিএমইএ নেতারা সংগঠনকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে আখের গোছানোর হাতিয়ার বানিয়েছেন। নেতারা এখন মন্ত্রী-মেয়র, এমপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ-পদবির নেশায় ব্যস্ত। সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ দর্জিতন্ত্রের কাণ্ডারি খ্যাত বিজিএমইএ।

নাম প্রকাশ না করে সাধারণ পোশাকশিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, পোশাক রপ্তানিতে বিভিন্ন ধরনের সনদ সংগ্রহ করেন মালিকরা। এই খাতে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার যে বাণিজ্য হয়, সেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তহবিল লুটপাটের অভিযোগে একটি উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করেছে দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। এক কথায় রাজনৈতিকভাবে কোটারি গ্রুপের কাছে জিম্মি বিজিএমইএ। সংগঠনটিতে নেই কোনো সুশাসন। বিজিএমইএ নেতারা কানাডার বেগমপাড়ায় পাচারের অর্থে বিশাল স্বর্গ গড়ে তুলেছেন। পোশাকশিল্প মালিকরা প্রতি বছর গড়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে, এমন তথ্য দিয়েছে দুদক।

এদিকে রাজনীতিতেও সুসময় বইছে পোশাকশিল্প মালিকদের। এক সময়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অথবা সুসম্পর্ক রেখে চলা অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি। দলীয় রাজনীতি না করেও কেউ কেউ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও মেয়রের দায়িত্বে আছেন। শুধু এমপি-মন্ত্রীই নন, দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতেও আসছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই এখন পাইপ লাইনে আছেন। যারা আওয়ামী লীগে সুবিধা করতে পারছেন না, তারা তলে তলে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে।

বিজিএমইএর তথ্য বলছে, বিগত ১২ বছরে ২ হাজার ৭৩৪টি পোশাকশিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে এসব কারখানা মালিকদের টিকে থাকতে তেমন কোনো সহায়তা করেনি বিজিএমইএ নেতারা। যদিও ফারুক হাসান বিজিএমইএ সভাপতি হওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার প্রধান লক্ষ্য হবে- এই শিল্পের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। অথচ সংগঠনটি এখন চরম ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি মনে করি বিজিএমইএ বর্তমান নেতৃত্ব অনেক বিষয় সমাধান করেছি। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। কোনো পোশাকশিল্প মালিক অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত না। বিজিএমইএ-তে সুশাসনের ঘাটতি নেই। আর প্রশিক্ষণ প্রকল্পে এডিবি অর্থ নিয়ে অনিয়মের ইতিহাস পুরনো। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট- বিএফআইইউর গত ১৫ মার্চ তথ্য দিয়ে বলেছে- বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোতে ৫ হাজার ২৮০টি ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন শনাক্ত করা হয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থ পাচার সংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। সে হিসাবে দেশে অর্থ পাচার এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেছে- তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পোশাকশিল্প মালিকরা এই অর্থপাচার করেছেন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রপ্তানির আড়ালে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগেরও অনুসন্ধান করছে দুদক। পাচারের এই আর্থিক পরিমাণ দুদককে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার মতে- একশ্রেণির অসাধু পোশাকশিল্প ব্যবসায়ীর অপকর্ম ও অনিয়মের কারণে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য এ খাতের ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এক শ্রেণির গার্মেন্ট উদ্যোক্তা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে আসছে। তারা বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে কাপড় এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতি বছর বন্ড সুবিধা দিয়ে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে। একশ্রেণির উদ্যোক্তা এসব সুবিধা গ্রহণ করে সরকারের রাজস্ব কম দিচ্ছে। রপ্তানির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় ফ্যাক্টরি বন্ধ, কোনো উৎপাদন নেই, অথচ বন্ধ কারখানার নামে কাঁচামাল আমদানি করে বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের সাবেক এই চেয়ারম্যান মনে করেন- বন্ড সুবিধার অপব্যবহারে কাপড় ও সুতা বাজারে বিক্রি করার ফলে সরকার শুল্ক-কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামপুর, সদরঘাট, নয়াবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব ব্যবসায়ী বন্ডের মাধ্যমে আমদানিকৃত কাপড় ও কাগজ বিক্রি করে, সেসব ব্যবসায়ী ভ্যাটও ফাঁকি দেয়। আবার বন্ড অপব্যবহারকারীরা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত বলেও শোনা যাচ্ছে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পলায়নকারীদের কেউ কেউ বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূর করতে না পারলে সরকারি রাজস্বের হাজার হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর অব্যাহতির কোনো সুফল তো পাওয়া যাবেই না। বরং আরও করফাঁকি, রপ্তানি হ্রাস, এমনকি ভুয়া রপ্তানি কিংবা রপ্তানি তথ্য গোপন করে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

 

সর্বশেষ খবর