বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

কোটি টাকার মাটি কাটলে জরিমানা লাখ টাকা

আজহার মাহমুদ, চট্টগ্রাম

শীত এলে যেন মাটি কাটার মহোৎসব শুরু হয়। কৃষিজমি, পাহাড়-টিলা কিছুই বাদ যায় না। চট্টগ্রামে ইটভাটায় মাটির জোগান, বসতভিটা, রাস্তা তৈরিসহ বৈধ ও অবৈধ নানা কাজে কৃষিজমির টপসয়েল ও পাহাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে। এসব মাটি কোটি টাকায় বিক্রি করছেন প্রভাবশালী মাটিখেকোরা। প্রশাসনের অভিযান হলে জরিমানার টাকাকে ব্যবসার খরচ ধরে সংশ্লিষ্ট দফতরের জন্য বৈধ ও অবৈধ বাজেট রেখে হাজার হাজার একর কৃষিজমি নিজেদের স্বার্থে খুন করছেন তারা।

বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার আয়তন ৩৪৭.৭২ বর্গকিলোমিটার। ৩ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যার এ উপজেলায় ইটভাটা আছে ১৫০টির মতো। উপজেলার কেবল তিন ইউনিয়নে আছে ১১৩টি ইটভাটা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৮৪৯ একরের ইসলামপুর ইউনিয়নে ২০ হাজারের মতো জনসংখ্যার জন্য ইটভাটা আছে ৭২টি। ৪ হাজার ৬৪৬ একরের দক্ষিণ রাজানগর এবং ১৯ হাজার ৭৭ একরের রাজনগর ইউনিয়নে আছে ৪১টি ইটভাটা।

এসব ইটভাটার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে পাহাড়ের পাদদেশে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ইটভাটার অনুমোদন নেই। রাঙ্গুনিয়ার সংরক্ষিত এলাকার পাহাড়, কৃষিজমি থেকে রাতের আঁধারে মাটি কেটে এসব ইটভাটায় সরবরাহ করার কারণে বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে অনেক কৃষিজমি ও পাহাড়। শুধু রাঙ্গুনিয়া নয়, সাতকানিয়া, রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই, হাটহাজারীসহ বিভিন্ন উপজেলায় দেদার কাটা হচ্ছে হাজার হাজার একর কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি, যা টপসয়েল বা জমির প্রাণ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মৌলভীর দোকান থেকে কেরানীহাট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় সম্পূর্ণ ফসলি জমিতে ৩০টি ইটভাটা আছে। উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ৩০টির মতো আছে ইটভাটা। এসব ইটভাটার জন্য প্রতিনিয়ত কৃষিজমি ও পাহাড়ের মাটি কেটে কোটি টাকা আয় করছেন মাটিখেকোরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত মাটিতে জমির মূল উৎপাদন শক্তি থাকে। টপসয়েল কেটে নিলে জমির উর্বরতা কমে যায়। ফলে কমে যায় উৎপাদনশীলতা। এসব টপসয়েল তৈরিতে এলাকাভেদে ২০ থেকে ৫০ বছর লাগতে পারে। জমিগুলো খানাখন্দে পরিণত হওয়ার ফলে অনেক জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’

প্রশাসনের জন্য বাজেট : চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় সম্প্রতি টপসয়েল কাটার অপরাধে অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসন। এর মধ্যে ১৬ জানুয়ারি লোহাগাড়া, ২৪ জানুয়ারি হাটহাজারীতে টপসয়েল কাটার অপরাধে দুই যুবককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। ২৫ জানুয়ারি সাতকানিয়ার এওচিয়ায় পাহাড়ের মাটি এবং ১৯ জানুয়ারি সন্দ্বীপে চরের মাটি কাটার অপরাধে দুই ব্যক্তিকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন অভিযান চালালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক সময় প্রশাসনকে ঘুমে রেখে রাতের আঁধারে মাটি কাটা হয়। ফলে কিছুই করার থাকে না। কিছু এলাকায় পুলিশ, পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর নাকের ডগায় মাটি কাটলেও তারা নীরব থাকে। স্থানীয় প্রশাসন ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইনে’ অপরাধীদের জরিমানা করলেও এ সংখ্যা খুবই কম। আবার কাউকে গ্রেফতারের নজির নেই বললেই চলে। মূলত এ কারণে প্রশাসনিক ঝামেলা মোকাবিলার জন্য মাটিখেকোরা ‘আর্থিক বাজেট’ রেখে অথবা মাসোহারা দিয়ে মাটি কাটেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘কৃষিজমি রক্ষার বিষয়ে সরকার খুব কঠোর। প্রতি ইঞ্চি কৃষিজমিকে আবাদযোগ্য করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। টপসয়েল কাটার বিরুদ্ধে প্রশাসন সর্বোচ্চ সক্রিয়। আইন অনুযায়ী অভিযান চলছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মাটিখেকো আসলে কারা : কৃষিজমি সুরক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরও জমি বিনষ্টের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা জড়িত। বিনা পুঁজিতে অধিক টাকা আয়ের সুযোগের কারণে মাটি কেনাবেচা এখন একরকম ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সরকার-সমর্থিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য, রাজনৈতিক নেতারাও এ কাজে যুক্ত। মাটি কাটার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন কয়েকজনের ভাষ্য, মাটি কাটার কারণে ১-২ লাখ টাকা জরিমানা করলেও সেটি দেওয়া সহজ। প্রশাসনের জন্য এর চেয়ে বেশি ‘বাজেট’ রাখা হয়। তাদের কথায়, ‘মাটি কেটে কোটি টাকা আয় করতে পারলে টাকা দিতে ক্ষতি কী!’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটতে প্রচুর সময় ব্যয় হলেও বর্তমানে এস্কেভেটর দিয়ে এক দিনেই অনেক মাটি কাটা সম্ভব। শ্রমিকরা এক-দুই ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কাটলেও এস্কেভেটরের কল্যাণে ৩০-৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কেটে নেওয়া সম্ভব। ফলে অনেক জমি চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। আবার একটি জমির মাটি গভীর করে কাটার ফলে পাশের জমির পাশ ভাঙতে শুরু করে। পরে ওই জমিও চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে জমির মালিক টপসয়েল বিক্রি করতে বাধ্য হন।

প্রতিবাদ করে বিপাকে : মাটিখেকোদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন অনেকে। টপসয়েল কাটার বিরুদ্ধে ফেসবুক পোস্টে প্রতিবাদ করায় ১১ জানুয়ারি সাতকানিয়ায় মিজানুুর রহমান ও ছরওয়ার কামাল নামে দুই তরুণকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে পকেটে ইয়াবা গুঁজে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পুলিশ মাটিখেকোদের পক্ষ নিয়ে মামলা নেয় এবং মামলার বাদী হন আবুবকর নামের এক ব্যক্তি, যিনি কি না এস্কেভেটরের মালিক এবং চিহ্নিত মাটিখেকো। ২৫ ডিসেম্বর রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নে ইটভাটায় সরবরাহের জন্য মাটি কাটার ছবি তুলতে গেলে হামলার শিকার হন একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক আবু আজাদ। এ ছাড়া প্রায়ই বিভিন্ন এলাকায় মাটি কাটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে হেনস্তার খবর পাওয়া যায়। তবে মাটিখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় খুব কম মানুষই এর প্রতিবাদ করেন।

সর্বশেষ খবর