সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মারাত্মক দূষণে সুন্দরবন

♦ বাড়ছে শব্দদূষণ ♦ ক্রুজ থেকে সরাসরি নদীতে ময়লা ♦ বনের ভিতর প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বস্তু ♦ ব্যাহত জীববৈচিত্র্য

জিন্নাতুন নূর, সুন্দরবন থেকে ফিরে

মারাত্মক দূষণে সুন্দরবন

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ বনের অপার সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার বিদেশি পর্যটক সুন্দরবনে আসেন। সুন্দরবনকে ঘিরে স্থানীয় পর্যটকদেরও আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি না থাকায় সুন্দরবন মারাত্মক পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। এ বনে পর্যটকবাহী বিলাসবহুল ক্রুজের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এসব ক্রুজের ডিজে পার্টি ও সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের পরিবেশ। গভীর বনে দাঁড়িয়ে থাকা এসব ক্রুজ থেকে খাবার ও পানির বোতলসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলে দেওয়ায় নদী দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া বনের ভিতরও পর্যটকরা বিভিন্ন অপচনশীল দ্রব্য ফেলে বন দূষিত করছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে এরকম চলতে থাকলে বনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে। পর্যটকরা চাইলেও তখন আর সহজে বনের পশুপাখি দেখার সুযোগ পাবেন না।

সম্প্রতি সরেজমিন সুন্দরবনের গহিনে প্রবেশ করে দেখা যায়, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের কাছে একসঙ্গে ১২টি বিলাসবহুল ক্রুজ অবস্থান করছে। এসব ক্রুজে থাকা যাত্রীরা রাতে বিকট শব্দে মাইকে গান বাজাচ্ছেন। ক্রুজের অতিরিক্ত আলোকসজ্জায় রাতের সুন্দরবনের আকাশ ও পরিবেশ অনুভব করা যাচ্ছে না। এসব ক্রুজ থেকে যাত্রীরা অনবরত প্লাস্টিকের বোতল, সিগারেটের টুকরোসহ বিভিন্ন খাবার নদীতে ফেলছেন। এ ছাড়া জাহাজের রান্নাঘরে ব্যবহৃত ময়লাসহ অপচনশীল দ্রব্যও নদীর পানিতে ফেলতে দেখা যায়। বনের ভিতরে আসা পর্যটক দলের অনেকেই খাবার প্যাকেট, পানির বোতল বনে ফেলে যাচ্ছেন। এতে বনের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

জানা যায়, সুন্দরবনে বর্তমানে ৫০টির বেশি যাত্রীবাহী ক্রুজ চলাচল করছে। সাধারণত একটি ক্রুজে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ জন যাত্রী পরিবহন করা যায়। এর মধ্যে সাত-আটটি ক্রুজ এখন ৭৫ জন যাত্রী পরিবহন করে। বাকিগুলো ৩০ থেকে ৫০ জন যাত্রী বহন করে। ছুটির দিনে সাধারণত এসব ক্রুজে সব মিলিয়ে দেড় থেকে ২ হাজার যাত্রী সুন্দরবনে আসেন। তেলচালিত এসব ক্রুজে শক্তিশালী ডাবল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। ফলে যখন এগুলো নদীর ওপর ছুটে চলে তখন আশপাশে বিকট শব্দ হয়। কয়েক বছর আগেও যে জাহাজগুলো সুন্দরবনে যাত্রী পরিবহন করত সেগুলোতে জেনারেটর থাকলেও মাত্র ৩ ঘণ্টা তা ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হতো শুধু বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য। সুন্দরবনে ট্যুর মূলত শুরু হয় শীতকালে। সে সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু যুগের সঙ্গে মানুষের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অনেক জাহাজে শীতকালেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য শক্তিশালী জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। ফলে বেশ শব্দ হয়। আর বনের ভিতর নিবিড় পরিবেশে এ শব্দ বহু দূর পর্যন্ত চলে যায়। এ শব্দে বনের ভিতরে থাকা পশুপাখিও বনের অনেক ভিতরে ঢুকে যায়। এ জন্য পর্যটকরা সুন্দরবনে এলেও এখন আর সকালের দিকে বনের পশুপাখি দেখার সুযোগ পান না। বন ঘুরে আরও লক্ষ্য করা যায়, কয়েক বছরে উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়েকটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গাছ শেকড়সহ উপড়ে পড়ে বনের এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু এসব গাছ সরিয়ে নিতে বা গাছের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

ট্যুরস অ্যান্ড ট্রিপস বাংলাদেশ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সুন্দরবনের সি-পার্ল ক্রুজ-৩ এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ট্যুর গাইড জুনাইদ ইসলাম জিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের জাহাজে সাউন্ড সিস্টেম থাকলেও আমরা শুধু কোনো ঘোষণা দেওয়ার জন্যই সেটি ব্যবহার করি। এতে গান বাজাতে দেই না। সুন্দরবনের পর্যটক বা ক্রুজ মালিকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, সুন্দরবন শুধু একটি ট্যুরিস্ট স্পট নয়। পর্যটকদের অযৌক্তিক চাহিদা যে ক্রুজ মালিকদের পূরণ করতে হবে এমনো নয়। সুন্দরবনে এসে ক্রুজে কোনো ডিজে পার্টি করা যাবে না। কোনো শিল্পী এনে এখানে গানবাজনা করা যাবে না। যে গাইডদের এসব ক্রুজে পাঠানো হবে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এতে এই গাইডরা প্রকৃত সুন্দরবনকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে পারবেন। সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষার জন্য জাহাজ মালিক ও গাইডদের বনের নিয়ম মানার জন্য আরও কঠোর হতে হবে। শীতকালে জাহাজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে।

ট্যুর গাইডদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন বিভাগ সুন্দরবনের রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে এখন যাত্রীবাহী ক্রুজে যাত্রীপ্রতি যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। তারা আরও জানান, বিদেশিদের জন্য বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া অনেক জটিল। এ ছাড়া সুন্দরবনে বর্তমানে বনরক্ষীরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যত ছোট-বড় গ্রুপই হোক তাদের সঙ্গে বন বিভাগ থেকে মাত্র একজন সশস্ত্র বনরক্ষী দেওয়া হচ্ছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর