দুই দিনে মোট ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে উত্তপ্ত প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সোমবার ২৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের পর গতকাল আরও ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে। গতকালের তালিকায় বঞ্চিতদের নাম কম দেখে হট্টগোল শুরু করেন তিনটি ব্যাচের শতাধিকের বেশি কর্মকর্তা।
জুনিয়র কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাও। অনেকেই ভয়ে আশ্রয় নেন অন্যের রুমে, ওয়াশরুমেও। তবে দিনভর হট্টগোলের পর সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের আশ্বাস পেয়েছেন বঞ্চিতরা। যে কোনো সময় ২৫ ও ৩৪ নতুন ডিসি নিয়োগের দুই প্রজ্ঞাপন বাতিল বা সংশোধন হতে পারে বলে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই প্রশাসনে নানামুখী রদবদল চলছে। এরই মধ্যে মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়া এবং পুরনো ডিসিদের ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত সোমবার ২৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয় আর গতকাল আরও ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। তবে গতকালকের ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের পরই উত্তপ্ত হয়ে উঠে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বঞ্চিত কর্মকর্তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে এই দুই দিনের ডিসি আদেশ বাতিল চান। গতকাল দুপুর ১টার দিকে শতাধিকের বেশি কর্মকর্তা ছুটে আসেন জনপ্রশাসনে। নতুন ডিসির তালিকায় কেন তাদের নাম নেই তা জানতে খুঁজতে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। ক্রমশ পাল্টাতে থাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিত্র। কর্মকর্তাদের আগমনে অনেকেই রুম ছেড়ে এদিক-সেদিক চলে যান। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের বঞ্চিত শতাধিকের বেশি কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে উচ্চবাচ্য শুরু করেন। এ সময় নানা স্লোগানে মিছিলও করেন তারা এবং এই নিয়োগ বাতিল চান। এ সময় ভিডিও চিত্র ধারণকে কেন্দ্র করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মীর নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে জানা গেছে। একপর্যায়ে বঞ্চিত কর্মকর্তারা নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের সামনে অবস্থান নেন। পরে তারা ফাইল মাঠ প্রশাসন অধিশাখার যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের রুমের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় আলী আযম পাশের রুমে অবস্থান নিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখেন। দীর্ঘ দুই ঘণ্টায় তিনি বের না হলে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অনেকে রুমের দরজা ধাক্কাধাক্কি করে ভাঙার চেষ্টা করেন। পরে ভিতর থেকে দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ সময় লাঞ্ছনার ভয়ে ওই যুগ্ম সচিব রাগোয়া ওয়াশরুমে আশ্রয় নেন। রুমের ভিতর ঢুকে বঞ্চিত কর্মকর্তারা টেবিল চাপড়াতে থাকেন। কেউ কেউ আরেক যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন, উচ্চবাচ্য করেন। প্রায় দের ঘণ্টারও বেশি সময় পর ব্যাচমেটদের আশ্বাস পেয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসেন মাঠ প্রশাসন শাখার যুগ্ম সচিব। পরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে যান।দুপুর থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জনপ্রশাসনের করিডর ও সংলগ্ন এলাকায় নানা ধরনের বিক্ষোভ করেন ডিসি না হওয়া বঞ্চিত কর্মকর্তারা। তারা বলেন, আমাদের কোনো ক্রাইটেরিয়ায় বাদ দেওয়া হলো জানতে চাই। আওয়ামী সুবিধা পাওয়া লোকজনই আবার চেয়ারে বসেছে। যারা বিভিন্ন সময় মন্ত্রী ও সচিবদের পিএস ছিল, ভালো স্থানে দায়িত্ব পেয়েছে তাদের নাম কেন ঘুরে ফিরে আসবে? বঞ্চিতরা কেন বারবার বঞ্চিত হবে, সে প্রশ্ন তুলে এই নিয়োগের আদেশ বাতিল চান বিক্ষুব্ধরা।
জানা গেছে, চার ঘণ্টার হট্টগোলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা ছুটে এলেও কোনো সমাধান করতে পারেননি। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এসেও কর্মকর্তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি বলেন, সভাপতির নির্দেশে দেখতে এসেছিলাম। অনেকেই বঞ্চিত আছেন এটাও সত্য। শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জনপ্রশাসনের বারান্দায় পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ছিলেন। বিকালের দিকে কয়েকজন সেনাসদস্যকেও দেখা যায়। ডিএমপির (সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা) উপকমিশনার মমতাজুল আহসান হুমায়ুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ফোর্স পরিস্থিতির বিষয়টি জানালে সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই পুলিশ সদস্য বাড়ানো হয়। তবে আমরা পরিস্থিতি দেখছি যেহেতু সবাই ক্যাডার কর্মকর্তা। সবাইকে নিরাপদ রাখাই আমাদের কাজ।’
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজ দপ্তরে বৈঠকে বসেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান, মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা, শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় মাঠ প্রশাসন অধিশাখার যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের কাছে সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন এবং সিদ্ধান্ত জানাবেন।’ বৈঠকে উপস্থিত একাধিক বঞ্চিত কর্মকর্তা বলেন, আমরা মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যারকে সার্বিক বিষয় অবহিত করেছি। এখানে ডিসি নিয়োগে কিছু জায়গায় টাকা-পয়সা লেনদেনের কথা শোনা গেছে। সে সব স্যারকে অবহিত করেছি। যারা বঞ্চিত, তাদের অযোগ্যতা কী, সেটা আমাদের প্রশ্ন ছিল। স্যার শুনে বলেছেন, ‘আমিও তো ডিসি ছিলাম না। আফসোস করো না। আমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার স্যারকে বলব।’ স্যার আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
এদিকে, আগের দিন সোমবার নিয়োগ পাওয়া ২৫ জন ডিসির মধ্যে একজনের নিয়োগ বাতিল করে নতুন একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাদ হওয়া ওই কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পি কে এম এনামুল করিম। যাকে সিলেটের ডিসি করা হয়েছিল। নানা সমালোচনার মুখে তার নিয়োগের আদেশটি বাতিল করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে সিলেটের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এনামুল করিমের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ফেনীর কলেজছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাঁচাতে প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, সোমবার যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের গতকাল আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া ৫৯ ডিসিকে আজ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সকালে ব্রিফিংয়ের জন্য ডাকা হয়েছে। গতকাল যারা ডিসি নিয়োগ পেলেন অর্থ বিভাগের উপসচিব মনোয়ার হোসেন মোল্লাকে মানিকগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. সাবেত আলীকে টাঙ্গাইল, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদারকে সিরাজগঞ্জ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তোশাখানা ইউনিটের পরিচালক (উপসচিব) মোস্তাক আহমেদকে সাতক্ষীরা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশরাফুর রহমানকে ঝালকাঠি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খানকে পিরোজপুর, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামকে চুয়াডাঙ্গা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব বনানী বিশ্বাসকে নেত্রকোনা, আরপিএটিসির উপ-পরিচালক মনোয়ারা বেগমকে রাজবাড়ী, ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ের উপ-ওয়াকফ প্রশাসক হাছিনা বেগমকে জামালপুরের ডিসি করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আবদুস সামাদকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব সুফিয়া আক্তার রুমীকে লক্ষ্মীপুর, জয়িতা ফাউন্ডেশনের পরিচালক (উপসচিব) মোছা. ইয়াসমিন আক্তারকে মাদারীপুর, জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ফৌজিয়া খানকে কিশোরগঞ্জ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহবুবুর রহমানকে রাজশাহী, নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের পরিচালক (উপসচিব) মোহাম্মদ দিদারুল আলমকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, পরিকল্পনা বিভাগের উপসচিব ফাতেমা তুল জান্নাতকে মুন্সীগঞ্জ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. আবদুল আজিজকে শরীয়তপুর, অর্থ বিভাগের উপসচিব আহমেদ কামরুল হাসানকে বাগেরহাট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরীক্ষা কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনকে পটুয়াখালী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে সুনামগঞ্জ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপসচিব মো. আজাদ জাহানকে ভোলা, খুলনা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক (উপসচিব) সিফাত মেহনাজকে মেহেরপুর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামানকে পঞ্চগড়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (উপসচিব) মো. আজহারুল ইসলামকে যশোর, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমকে বরগুনা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানকে নড়াইলের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেতু বিভাগের উপসচিব শরিফা হক নীলফামারী, ভূমি সংস্কার বোর্ডের উপভূমি সংস্কার কমিশনার নুসরাত সুলতানা কুড়িগ্রাম, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) এইচ এম রকিব হায়দার লালমনিরহাট, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. দেলোয়ার হোসেন বরিশাল, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইশরাত ফারজানা ঠাকুরগাঁও, জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী নরসিংদী এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মোবাশশেরুল ইসলাম দিনাজপুরের ডিসি হয়েছেন। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে ডিসি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসি জেলার সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো দেখে থাকেন। এ ছাড়া নির্বাচিত সরকারের বিশেষ কর্মসূচি এবং চলমান সব উন্নয়নমূলক কাজে জেলা প্রশাসক তদারকি করে থাকেন।