তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রায় ১১ মাস গত হয়েছে। অথচ দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ আগের অবস্থায়ই বিরাজ করছে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার ক্ষেত্রে কৌশল ও নীতিগত তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি উভয়ই কমেছে। ফলে দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই একটি বিনিয়োগ সম্মেলন করা হয়। এতে বিদেশিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও সেখান থেকে তেমন কোনো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আসেনি। ওই সম্মেলনের পর সামিটে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ রক্ষা করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কেননা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। নির্বাচিত সরকার না থাকায় তারা আস্থা পাচ্ছেন না। এদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা না কাটায় বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ করছেন না বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। ফলে নতুন অর্থবছরেও বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে কারণে আগামী অর্থবছরও দেশের অর্থনীতি সংকুচিতই থাকবে। অবশ্য সরকারও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে এনেছে। সংস্থা দুটি তাদের পৃথক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া প্রায় দুই মাস ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার নিয়ে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে একধরনের নেতিবাচক বার্তা গিয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অবশ্য রবিবার সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। সূত্রগুলো বলছে, অব্যাহত জ্বালানিসংকট, ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় কম। এর প্রভাব পড়েছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতেও। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বাড়ানো ও দুর্নীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৯ মাসে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি বাড়লেও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে মধ্যবর্তী পণ্য ও পেট্রোলিয়াম আমদানি। আলোচ্য সময়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি এলসির পরিমাণ ২৬ শতাংশ কমেছে। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় দুটোই কমেছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয় ছিল ২৩৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা বছর ব্যবধানে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ কম। একই সময়ে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত মার্চ মাসে ৬৩৫ কোটি ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের প্রায় ৫৫৩ কোটি ডলারের তুলনায় ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ায় ব্যাংকিং খাতে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। পাশাপাশি আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এলসি খোলা বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরের গণ অভ্যুত্থান হয়েছে, স্বৈরশাসনের পতনও হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা তো কাটেনি। যাতে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়নি। সংস্কারগুলো ঠিকঠাক শেষ করা যায়নি। ব্যাংকঋণেরও সুদহারও চড়া। জ্বালানিসংকটের কারণে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। এই অবস্থায় বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর নিট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২৩ সালে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০২৫ শেষে এই ধারা আরও নেতিবাচকই থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটানো। এমন পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর যখন বিকল্প নেই। তখন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিতে ভাটা পড়া বৈশ্বিক বাজারের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে সামনের দিনে দেশের অর্থনীতি আরও গভীর সংকটের দিকে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দেশে এখনো ব্যবসার পরিবেশে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বন্দর, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও ইনকাম ট্যাক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আগের সমস্যাগুলোই রয়ে গেছে। এর ওপর এলডিসি থেকে উত্তরণের পর নতুন ধরনের চাপ আসবে কি না, তা নিয়েও ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।