দেশের পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংক একীভূত হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকে রূপ নিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়েছে। আগামী নভেম্বরে পূর্ণোদ্যমে শুরু হবে একীভূত কার্যক্রম। একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ঘোষণার পর থেকেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-গ্রাহকরা কবে তাঁদের টাকা ফেরত পাবেন? আর এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমানতকারীদের টাকা তোলা। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকে আমার টাকা জমা আছে, কিন্তু তুলতে গেলে বলেন পরে আসতে।’ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোতালেব হোসেন অভিযোগ করেন, ‘জরুরি চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, কিন্তু কয়েকবার গিয়েও পাইনি। একবার মাত্র ১০ হাজার টাকা তুলতে পেরেছি।’ আরও একজন গ্রাহক জানান, ‘১ লাখ টাকার চেক দুই মাস ধরে হাতে নিয়ে ঘুরছি, টাকা দিতে পারেনি শাখা।’ বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একীভূতকরণে প্রাথমিকভাবে খরচ হবে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেবে সরকার। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া শুরু হবে। ছোট ছোট আমানতকারীদের টাকা আগে ফেরত দেওয়া হবে। পাঁচ ব্যাংকের সব গ্রাহকের আমানত সুরক্ষিত, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সে নিশ্চয়তা দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে আমানতকারীরা এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে জমা রাখছেন। এমন হলে ব্যাংকগুলো চলবে কীভাবে? আমরা সবার জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই-সব গ্রাহক টাকা ফেরত পাবেন।’ অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, একীভূত প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়িত না হলে ব্যাংক খাতে আস্থার ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘সফল মার্জার না হলে গোটা ব্যাংকব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট তৈরি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত আমানতকারীদের টাকা ফেরতের একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক একত্র করলে বড় দুর্বল প্রতিষ্ঠানও তৈরি হতে পারে।
তবে একীভূত হওয়ার তালিকায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘পাঁচটি ব্যাংকে ১ কোটি গ্রাহক রয়েছেন। তাঁদের স্বার্থেই একীভূত করা হচ্ছে। আশা করি মার্জারের পর গ্রাহকদের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ খেলাপসহ নানান কারণে বিশ্বে এমন ব্যাংক একীভূত করার নজির থাকলেও বাংলাদেশে এর আগে এ ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ পাঁচটি ব্যাংকের ৪৮ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ এখন খেলাপি রয়েছে। যে কারণে তারা গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। গ্রাহকের নানান অসন্তুষ্টির মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ একীভূত করার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, একীভূতকরণের তালিকায় থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের ৭৭৯টি শাখা রয়েছে। উপশাখা রয়েছে আরও ৬৯৮টি। প্রায় ৫০০ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ১ হাজারের বেশি এটিএম বুথ। জনবল রয়েছে ১৫ হাজারের বেশি। এসব ব্যাংকে গ্রাহক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ৯২ লাখ।
পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, অথচ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের তুলনায় ঋণ অনেক বেশি। এ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। সেই অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ার পরও কোনো লাভ হয়নি, তাই একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।