সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এক বছর তিন দিনের শিশু রাফায়েতকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন রানু বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের দইবার নিউমোনিয়া হয়েছে। চার দিন আগে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছিল চিকিৎসকরা। বাড়ি যাওয়ার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন হাসপাতালে এলে আবার ভর্তি করিয়ে নেয়। এখন কিছুটা সুস্থ। সাত মাস বয়সেও একবার নিউমোনিয়া হয়েছিল, তখন বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।’
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। এখনো প্রতিদিন ৭৪ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ফলে নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর মৃত্যু হচ্ছে ২৬ হাজার ৭৬৬ শিশুর। শুধু বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালেই প্রতিদিন আসছে শতাধিক নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৫১১ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিল। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬০-এ। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ১৩৬ শিশু চিকিৎসা নিয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ‘এখানে ঢাকার বাইরের রোগীই বেশি আসে। কারণ সংকটাপন্ন রোগীদের এ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দেশে এখনো পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর এক নম্বর কারণ নিউমোনিয়া। দেশে যত শিশু মারা যায় তার এক তৃতীয়াংশ নিউমোনিয়ায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে নিউমোনিয়ার টিকা শুরু হওয়ার ফলে মাঝখানে নিউমোনিয়া অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এটা আবার সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। আমরা জটিল নিউমোনিয়ার রোগী বেশি পাচ্ছি। এর একটা কারণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যানস। নিউমোনিয়াতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। হাইপোক্সেমিয়া হলে অক্সিজেন দেওয়া, খেতে না পারলে তাকে খাবার দেওয়া, সেটা নাকে নল দিয়ে বা মুখে হোক, পাশাপাশি তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া-এ চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় কোথাও যদি ঘাটতি থাকে তাহলে মৃত্যু বাড়বে। যে কারণে “বাবল সিপ্যাপ” আমাদের দেশে এত জনপ্রিয় হয়েছে।’ চিকিৎসকরা বলেন, নিউমোনিয়া ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। এতে শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট হয়। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাল, ধুলাবালিসহ বিভিন্ন কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। বছরজুড়ে নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যায়। তবে ঋতু পরিবর্তনের সময় নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ে। ভাইরাল নিউমোনিয়া শীতকালে বাড়ে। তবে ব্যাকটেরিয়ার কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো মৌসুম নেই। শীতকালে দরজা-জানালা বন্ধ রেখে ঘরে যদি আগুন জ্বালিয়ে রান্না করা হয় তখন ঘরের দূষণ বাড়ে। এতে শিশুদের রেসপিরেটরি ইনফেকশন হয়ে যায়। টিকার মাধ্যমে শক্ত ইমিউনিটি তৈরি করতে পারলে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘নিউমোনিয়া মূলত ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি রোগ, যা সাধারণত কাশির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়, তবে অনেক সময় শ্বাসকষ্টের জটিলতা সৃষ্টি করে মৃত্যুর কারণও হতে পারে।’ তিনি আরও জানান, ‘শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের আগে থেকেই হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, তারা গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই সঠিক চিকিৎসা জরুরি।’
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুকে ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি ২৩ শতাংশ কমে যায়। বিশ্বেও পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এখনো বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২ এবং বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটোলজি ও পেডিয়াট্রিকস বিভাগের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া।