একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় ঘোষণা করা হবে আজ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করবেন। গতকাল বিকালে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় রায় ঘোষণার জন্য মামলাটি এক নম্বর ক্রমিকে দেখা গেছে।
এর আগে শুনানি শেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করা হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আসামিপক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং এস এম শাহজাহান শুনানিতে অংশ নেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির বিরুদ্ধে মোট ১৪ অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালে। এই আদালতে প্রমাণিত ১০ অভিযোগের মধ্যে একাদশ অভিযোগে সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও দ্বাদশ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। অন্য আট অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে তাকে দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি চারটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। কারাগার থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মীর কাসেম। গত ৯ ফেব্রুয়ারি আপিলের শুনানি শুরু হয়।
যত অভিযোগ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৪ অভিযোগে মীর কাসেমের বিচার হয়। তবে বিচারে প্রমাণিত হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও চতুর্দশ; এই ১০টি অভিযোগ। এর মধ্যে একাদশ অভিযোগে সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও দ্বাদশ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় মীর কাসেমকে। প্রমাণিত অন্য আট অভিযোগে মোট ৭২ বছরের দণ্ড পান তিনি। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় লুত্ফর রহমান ফারুককে। তৃতীয় অভিযোগ, ২২ বা ২৩ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয় ডবলমুরিং থানা এলাকার কদমতলীর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। চতুর্থ অভিযোগ, ২৪ নভেম্বর মীর কাসেমের উপস্থিতিতে সাইফুদ্দিন খানকে বাসা থেকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে আল বদর বাহিনী। ষষ্ঠ অভিযোগ, ২৮ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে হারুন-অর-রশিদকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। সপ্তম অভিযোগ, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরীসহ দুজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে ডালিম হোটেলে। নবম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে সৈয়দ মো. এমরানসহ ছয়জনকে অপহরণ ও নির্যাতন। দশম অভিযোগ, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে মো. জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরণ ও নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। একাদশ অভিযোগ, একাত্তরের ঈদুল ফিতরের পর যে কোনো এক দিন মীর কাসেমের নেতৃত্বে জসিম উদ্দিনকে অপহণের পর নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। নির্যাতনে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচ অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। দ্বাদশ অভিযোগ, নভেম্বরের কোনো এক দিন মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা অপহরণের পর ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ তিনজনকে। জাহাঙ্গীর বেঁচে গেলেও এতে নিহত হন দুজন। চতুর্দশ অভিযোগ, নভেম্বরের শেষ দিকে মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর সদস্যরা নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ ও নির্যাতন করে আল বদর সদস্যরা। একাদশ ও দ্বাদশ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দশম অভিযোগে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় আসামিকে। আর দ্বিতীয় অভিযোগে ২০ বছর এবং চতুর্দশ অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে।
গণজাগরণ মঞ্চ আজ সকাল থেকে রাজপথে থাকছে : মানবতাবিরোধী অপরাধে আল বদর কমান্ডার মীর কাসেমের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে আজ সকাল থেকে রাজপথে থাকছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল বিকালে গণজাগরণ মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচি থেকে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার এ ঘোষণা দেন। একই দাবিতে গতকালও সকাল থেকে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন ও সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছেন মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। অবস্থান কর্মসূচিতে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্টসহ জামায়াতের বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক এই বিত্তবান যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর থেকে এই মীর কাসেম মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে লবিস্ট নিয়োগ করেছে বলে বারবার গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় পাওয়া মীর কাসেমের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত রায়কে কেন্দ্র করে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়। একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মীর কাসেমের পক্ষে মামলায় লড়েন। এ ছাড়াও নানা মহল থেকে বারবার ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালানো হয়। গণজাগরণ মঞ্চ মীর কাসেমকে রক্ষার সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। ভবিষ্যতেও রাজপথে থাকবে।
বিডি-প্রতিদিন/০৮ মার্চ ২০১৬/ এস আহমেদ