সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দুঃখ হয় যারাই ক্ষমতায় আসে, সে-ই ক্ষমতাকে অপব্যয় করে, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে। দেশের মালিক জনগণ। আইনের শাসন মানে হলো জনগণর শাসন। জনগণের শাসন হলো প্রকৃত অর্থে কার্যকর গণতন্ত্র। এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। দেশে যেন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, দেশের মালিক জনগণকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন সামনে নির্বাচন। প্রত্যেককে নির্বাচন করার, পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার অধিকার দিতে হবে। কারণ দেশের মালিক সেই জনগণ, তাদের ভোটে নির্বাচিত সংসদই কেবল কার্যকর গণতন্ত্র দিতে পারে, জবাবদিহি আদায় করতে পারে।
মঙ্গলবার রাজধানীতে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত ‘আইনের শাসন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিচারপতি আবদুল মতিন।
ড. কামাল হোসেন আরও বলেন, পাকিস্তানের মাত্র ২৪ বছরে তিনটি সংবিধান ভাগাড়ে ফেলা হয়েছিলো। ৪৭ বছরে আমাদের সংবিধান টিকে আছে। শুধু সমালোচনা করলে চলবে না, আমাদের বিচার বিভাগের অসাধারণ কৃতিত্ব আছে। স্বৈরাচার জমানায় যখন উচ্চ আদালত বিভক্ত করার কথা উঠেছিলো সে সময়ে আমাদের বিচারপতিরা তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। আমাদের বিচারপতিরাই সপ্তম, অষ্টম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। আজ ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। তবে বাস্তব সত্য হলো বিচারপতিরা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছেন, এটা বাতিল হয়ে গেছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, দেশের সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিকে কেউ কেউ টেলিভিশনে যখন ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে বলেন, ব্যাটা তোকে কে নিয়োগ দিয়েছে? তখন কেবল তিনি একা অমানিত হন না, গোটা দেশ অপমানিত হয়।
ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বলেন, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় বলা হয়েছে সাম্য, মানবিকতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। এটা খুবই গুরত্বপূর্ণ। আমাদের সংবিধানে যেভাবে আইনের শাসনের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে এটা দুনিয়ার কোথাও পাবেন না। তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নানা দিক আছে, ফ্যাক্টর আছে। রাষ্ট্রের অনেকগুলো কাঠামো আছে যে গুলোর ওপর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বর্তায়, সে কাঠামোগুলো ঠিকমত কাজ করছে না।
তিনি আরো বলেন, বিচারক নিয়োগে আইন করার জন্য আমরা স্বাধীনতার প্রারম্ভে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। তখন বলা হলো সংবিধানের রাখার দরকার নেই। পৃথক আইন করে নেব। কিন্তু গত ৪৭ বছর পরও তা হয়নি। শুধু তাই নয়, বর্তমানে আমাদের দেশে প্রশাসন ও বিচার বিভাগ-সহ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, সংবিধানের প্রথমেই বলা হয়েছে আমরা আইনের শাসন করবো। তা হয়নি। আজ বিনা বিচারে মানুষ হত্যা চলছে। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে যে তাণ্ডব হলো তা কি ঠিক হয়েছে? তিনি আরো বলেন, জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা যদি আইন প্রণীত না হয়, সেটা জনগণ মানতে বাধ্য নয়। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, আইনের শাসন মানে জনগণের সম্মতির শাসন। আইন হতে হলে তাতে জনগণের সম্মতি থাকা লাগবে এবং আইন হতে হলে তা বিচারকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ আহমদ বলেন, আমি আইনের শাসন বলতে বুঝি যেখানে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকবে, অন্যায়কারীরা ভয়ে থাকবে এবং দুর্বল ব্যক্তিরা নিরাপদে থাকবে-সেটাই আইনের শাসন। দেশে কম গণতন্ত্রের শাসন সহ্য করা যায়। কিন্ত আইনের শাসনের অভাব হলে রাষ্ট্র অকার্যকর হতে বাধ্য।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের সর্বত্র আইনের আড়ালে বেআইনী কাজ চলছে। আমরা সুবিধাভোগীরা যার যার অংশ হারে সুবিধা নিয়ে চুপ থাকি। সংবিধানে তো ভিআইপ বলে কোন কথা লেখা নেই। তা হলে আজ যত্রতত্র ভিআইপি কোটা হচ্ছে কিভাবে? রাজউক প্লট দেয় সেখানে এমপিদের কোটা, সচিবদের কোটা, কর্মচারীদের কোটা এই কোটা আবিষ্কার হলো কিভাবে? এটা তো সংবিধানের মৌল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আইন প্রণেতাদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হতে হবে। যে আইন প্রণেতা বিনাভোটে নির্বাচিত তাদের প্রণীত আইনের নৈতিক ভিত্তি আছে কীনা? এটা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন সঠিক হতে হবে। যে কারণে আমরা সামরিক শাসনের আইনকে আমরা আইন হিসেবে সাধারণত মেনে নেই না। আর আইন কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে, কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে না তা আমরা মেনে নিতে পারি না।
সাবেক সংসদ সদস্য এসএম আকরাম বলেন, আইনের শাসন মানে জনগণের অভিপ্রায়। কিন্তু আজকে জনগণের মন-মানসিকতা বিবেচনা না করে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে আইন পাশ করা হচ্ছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইনের শাসন ছাড়া যে শাসন তা সভ্য শাসন নয়। বিচারপতিদের নিয়োগে আইন পাশ করার দাবি জানান তিনি।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে আইনের শাসন নেই। বরং দেশে আছে দুঃশাসন ও অপশাসন। আজকে একটা মহল দেশের ইচ্ছামত দেশ পরিচালনা করছে। আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ব্যবসা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় দেশকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আলোচনায় আরো অংশ নেন সৈয়দা রোজোয়ানা, আহমেদ, গোলা মুর্তজা প্রমুখ।
বিডি-প্রতিদিন/০৩ এপ্রিল, ২০১৮/মাহবুব