দেশের অন্যতম নৌরুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় চলাচলরত ফেরির ক্যান্টিন পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়মের খবরে নজরদারি বাড়িয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। 'ফেরির ক্যান্টিনে পচা-বাসি খাবার ও উচ্চমূল্য, যাত্রীরা অসহায়' শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ গত ২০ এপ্রিল খবর প্রকাশের পর বেশ কয়েকবার অভিযান চালায় রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার ভোক্তা অধিকার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা।
সবশেষ ১লা মে থেকে এ রুটে চলাচলরত বড় ফেরিগুলোতে (রো রো ফেরি) নোটিশ আকারে ব্যানার টানানো হয়েছে। ব্যানারে সংশ্লিষ্ট ফেরির নামের নিচে 'এই ফেরিতে নির্ধারিত মূলে সকল পণ্য বিক্রয় করা হয়' এমন বিজ্ঞপ্তি টানানো হয়েছে। এছাড়া ফোন নম্বরসহ অন্য একটি বিজ্ঞপ্তিতে পণ্যের মূল্য বেশি রাখা হলে সরাসরি ফোন করে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে ছোট ফেরি (ইউটিলিটি) 'মাধবীলতা'য় এ ধরণের কোন ব্যানার বা বিজ্ঞপ্তি লক্ষ্য করা যায়নি।
এদিকে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের এমন কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। তবে অনেকে অভিযোগ করেছেন বিজ্ঞপ্তি টানানো থাকলেও কেক বা বিস্কুট যাতীয় খাদ্যপণ্যে আগে ৫-৭ টাকা বেশি নেওয়া হলেও নির্ধারিত মূল্য থেকে এখন ২-৩ টা বেশি নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের দাবি, এমন তদারকি সারা বছর চলমান থাকলে তবেই স্বস্তি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহ্ মুখদম ফেরির ফাস্টফুড বিক্রেতা বলেন, 'একদিকে ক্যান্টিন ভাড়া বেশি, অন্যদিকে ফেরিতে পণ্য পরিবহন খরচ দিয়ে পোশায় না। তাই যাত্রীদের কাছ থেকে বলেই দু-এক টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। তা না হলে আমাদের পেট চলবে কিভাবে?'
শুক্রবার ইউটিলিটি ফেরি মাধবীলতা'য় রাজিয়া নামের এক যাত্রী ফাস্টফুড দোকান থেকে ৩০ টাকার কোমল পানীয়'র একটি ক্যান কিনতে চাইলে তার কাছে ৩৫ টাকা দাম চাওয়া হয়। এসময় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কথা বলা হলে বিক্রেতা ৩০ টাকা দাম রাখেন।
জানা যায়, বর্তমানে ছোট-বড় (ইউটিলিটি-রো রো) ১৯টি ফেরি এ রুটে চলাচল করছে। গড়ে একটি ফেরি প্রতিদিন ২০-২২ বার যানবাহন পারাপার করে থাকে। সে হিসেবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ রুটে ফেরি পার হয়ে থাকেন।
ফেরির ক্যান্টিনে পচা-বাসি, মেয়াদোর্ত্তীণ খাবার ছাড়াও উচ্চমূল্য নেওয়ার অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যাত্রীদের একপ্রকার 'গলা কাটছিলেন' ক্যান্টিন পরিচালকরা।
রো রো ফেরির ক্যান্টিনগুলোর তিনটি অংশের বৃহৎ জায়গা জুড়ে খাবারের হোটেল, একটি টি স্টল ও একটি ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। খাবারের হোটেলে দামের কোন পরিবর্তন হয়নি। সেখানে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক টানানো তালিকা অনুযায়ী মুরগী অথবা মাছের কারী-ভাত-ডাল-সবজি ১৪০ টাকা, খাসির কারী-ভাত-ডাল-সবজি ১৭০ টাকা, ইলিশ ফ্রাই-ভাত-ডাল-সবজি ১৬০ টাকা, ডিমের কারী-ভাত-ডাল ১০০ টাকা, ভুনা খিচুড়ি ১৮০, পোলাও মুরগির কারী ১৭০ ও পোলাও খাসির কারী ২০০ টাকা।
রাজবাড়ী জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শরীফুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি রাজবাড়ী ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে দুটি ফেরিকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দিব না।
তিনি আরো বলেন, কোন যাত্রীর কাছে বেশি দাম দাবি করলে ওই যাত্রী আমাদের এই নির্দেশনার বিষয়টি বিক্রেতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন। এতেও কোন কাজ না হলে যাত্রীরা আমাদের কাছে লিখিত অথবা (০১৭৪৪-৫৯২১২২) অভিযোগ করতে পারেন।
মানিকগঞ্জ জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল বলেন, সম্প্রতি কাবেরি ফেরির ক্যান্টিন পরিচালককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, তদারকি করছি। এটা শুধু রমজান মাস উপলক্ষে নয়, সারা বছরই আমরা সেখানে অভিযান চালাই।
তিনি বলেন, যাত্রীদের সুবিধার্তে মোবাইল নম্বর (০১৭৫৮-৮৩৩১৬১) দিয়েছি, অনেক যাত্রী ফোন করছেন। আমরা সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক অভিযুক্ত ফেরির ক্যান্টিনে যোগাযোগ করে সতর্ক করছি।
তিনি যাত্রীদের অভিযোগ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে বলেন, যে কোন পণ্যের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য রাখা হলে যাত্রীরা সরাসরি আমাদের ফোনে অভিযোগ করতে পারেন। অথবা লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলে সেই জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী যাত্রীকে দেওয়া হবে।
এদিকে ক্যান্টিন সংশ্লিষ্টরা ক্যান্টিন ভাড়া কমানোর দাবি তুলেছেন। শাহ্ মুখদম ফেরির ক্যান্টিন কর্মচারী রাজ্জাক বলেন, ক্যান্টিন ভাড়া বেশি হওয়ায় যাত্রীদের কাছ থেকে কিছু টাকা বেশি নেওয়া হতো। নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করলে আমাদের তো পেট চলবে না। ক্যান্টিন ভাড়া কমালে সবকিছুর দাম নির্ধারিত মূল্যে রাখতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।
বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতিবছর ক্যান্টিন ভাড়া দেওয়া হয়। ঠিকাদাররাই বেশি ভাড়া দিয়ে ক্যান্টিন ইজারা নেন। এতে আমাদের কিছু করার নেই।
তিনি আরো বলেন, বড় ফেরিতে দৈনিক ভিত্তিতে ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্যান্টিন ইজারা নেন ঠিকাদাররা। তারা কম টাকা দিয়ে ইজারা নিলেতো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল