বান্দরবানের লামা থানার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের থাবা থেকে স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের শেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমি রক্ষার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন হল রুমে সংবাদ সম্মেলন থেকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূমি দখল বন্ধ করে ম্রো ও ত্রিপুরাদের ভোগ দখলীয় ৪০০ একর জুম ভূমিসহ কোম্পানি কর্তৃক বেদখলকৃত সকল জমি ফেরত দেওয়া; কোম্পানির কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরাদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ; জুম ভূমি কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা, অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা ভাঙচুর ও বুদ্ধ মূর্তি লুট এবং ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার উপর হামলার সাথে জড়িত কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন, জহির উদ্দিন গংদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা। এসময় কমিটি’র সদস্য সচিব লাংকম ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক রেংয়েন ম্রো, যুগ্ম আহ্বায়ক ফদরাম ত্রিপুরা, যুগ্ম আহ্বায়ক সংলে ম্রো, সদস্য মথি ত্রিপুরা, সদস্য রুইপাও ম্রো উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বান্দরবানে রাবার ও অন্যান্য বাগান সৃজন কিংবা পর্যটন উন্নয়নের উদ্দেশ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া সকল জমির লিজ বাতিলের দাবি জানানো হয়।
রংধজন ত্রিপুরা বলেন, লামা উপজেলায় সরই ইউনিয়নের ৩০৩ নম্বর ডলুছড়ি মৌজায় আমাদের ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ৪০০ একর জুম ভূমি রয়েছে, যা আমরা বংশপরম্পরায় তিন গ্রামবাসী লাংকম পাড়া (ম্রো কারবারি), জয় চন্দ্র পাড়া (ত্রিপুরা) ও রেংইয়েন পাড়ার (ম্রো) ৩৯ পরিবার ভোগদখল করে আসছি। গত ৯ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম গং ২০০ জনের অধিক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ভাড়া করে ভূমিজ সন্তান লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্র পাড়া ও রেংয়েন পাড়াবাসীর উক্ত জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চালায়। তারা আমাদের লাগানো ফলদ চারা যেমন আনারস, বরই, আম, জাম, কাঠাল গাছ ও বাঁশ বাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাফ করে দেয়। এরপর ২৬ এপ্রিল তারা ওই জমির বাগানে আগুন দিয়ে প্রাকৃতির পরিবেশসহ লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করেছে।
তিনি আরো বলেন, লামার বিস্তীর্ণ এলাকার জমি একসময় সম্পূর্ণ ম্রো ও ত্রিপুরাদের মালিকানার অধীনে ছিল। সেখানে পাহাড়িরা জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তখন সেখানে কোনো কোম্পানি ও ব্যক্তির নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা বহিরাগতের জমি ছিল না। কিন্তু জেলা প্রশাসন পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি আইনকে তোয়াক্কা না করে গত ১৯৮০-৯০ দশকে বেআইনিভাবে বহিরাগতদের নামে-বেনামে জমি লিজ দেওয়ায় উক্ত জুম ভূমি থেকে ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন উচ্ছেদ হতে থাকে। প্রশাসনের সহায়তায় মন্নান বাগান, মকবুল উকিল বাগান, ক্লিফটন এগ্রো, মেরিডিয়ান এগ্রো, গাজী গ্রুপ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, নিজামপুর এগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেড, হামেলা হোসেন ফাউন্ডেশন, পাহাড়িকা প্লানটেশনসহ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নামে ভূমি দস্যুরা জমি লিজ নেয়। ফলে সেসব জমি থেকে পাহাড়িরা উচ্ছেদ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ডলুছড়ি মৌজায় ১৯৮৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময় মোট ৪৮ জনের নামে ১২০০ একর জমি লিজ নিয়েছিল। অপরদিকে একই ইউনিয়নের সরই মৌজায় ১৬ জন শেয়ার হোল্ডার ২৫ একর করে মোট ৪০০ একর ভূমি লিজ নেয়। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৪০ বছরের জন্য ৬৪ জনের নামে দুই মৌজায় (১৯৮৮-১৯৯৪) মোট ১৬০০ একর জমি লিজ নেয়। তবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে দলিলে লিজ নেওয়া জমির পরিমাণ ১৬০০ একর হলেও বাস্তবে তার পরিমাণ ৩০০০-৩৫০০ একরেরও বেশি। তারা এত বিশাল পরিমাণ জমি নানান কায়দায় বেদখল করেও ক্ষান্ত হয়নি, এখন কোম্পানিটির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে পূর্ব দিকে অবস্থিত লাংকম পাড়া, জয়চন্দ্র পাড়া এবং দক্ষিণে রেংয়েন পাড়ার জমি। এই জমিতেও তারা রাবার বাগান করতে চাইছে। লিজ চুক্তিতে ইজারা গ্রহীতাদের ২৮টি শর্ত দেওয়া হলেও কোনোটিই তারা মেনে চলেনি।
বিডি প্রতিদিন/এমআই