জাতিসংঘ বিশ্ব জাতিসমূহের একটি সংগঠন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার ও নীতির উপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সকল মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য। তাই জাতিসংঘের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে যখন একজন রাষ্ট্রনায়ক কথা বলেন তখন তা এক বিশেষ বার্তা হিসেবে ধরা হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আগে থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, কাশ্মীর ইস্যু বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘের মতো বড় প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগাতে চাইবেন তিনি, হয়েছেও তাই। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে তিনি এমন কিছু শব্দচয়ন করেছেন যা একেবারেই অনভিপ্রেত এবং মধ্যযুগীয় মানসিকতার প্রতিফলন। জাতিসংঘ সম্ভবত প্রথম এই ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এসেও শান্তির পরিবর্তে হুমকি এবং ঘৃণাভরা এক বক্তব্য প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। এই ভাষণ নতুন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে সবাইকে, যে প্রশ্নগুলোর জন্মদাতা খোদ পাকিস্তানই।
দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে আমরা প্রায়ই উত্তেজনা দেখি এবং রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করার বক্তব্যও শুনি। তবে তা শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য একবিংশ শতকের এই যুগে এসেও সম্মুখ যুদ্ধের সরাসরি হুমকি শুনতে হলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছ থেকে। জাতিসংঘের মতো কোন ফোরামে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেয়া কোন রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্য হতে পারে না। তবে আমরা হরহামেশাই এরকম হুমকি দেখি ভিডিওবার্তায় আলকায়দা বা আইএস এর সদস্যরা দিয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এসেও জাতিসংঘের মতো বড় আসরে কেউ এভাবে বক্তব্য দিতে পারে তা ছিলো অকল্পনীয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান বিশ্ব যে যুদ্ধে নেমেছে তাকে নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে এই বক্তব্য। ইমরান খানের বক্তব্য পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করছে, যা বিশ্ব শান্তির পথে কাজ করা প্রতিটি সংগঠন ও মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ।
জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইমরান খান এথনিক ক্লিঞ্জিং এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করার যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে দ্বিচারিতামূলক। একদিকে আপনি নিজের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করবেন, অপরদিকে মেকি মানবতার বাণী শুনাবেন, তা কপটতা এবং ভণ্ডামি। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে মাইনোরিটি কমিউনিটি ছিলো ২৩%, যা আজ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩% এ। খ্রিস্টান, শিখ, আহমাদিয়া, হিন্দু, শিয়া, পশতুন, সিন্দিজ, বেলুচিসসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা মধ্যযুগীয় বর্বর ব্লাসফেমি আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট। নিজ দেশে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের নির্মূল করা হচ্ছে, সেখানে বিশ্ব মানবতা সম্পর্কে কিভাবে শিক্ষা দিতে আসেন ইমরান খান?
ইমরান খান সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে দায় মুক্তির দিকে হেঁটেছেন। কিন্তু হাঁটতে চাইলেই কি তা পারা যায়। ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের জন্য যে দায়ী করে আসছে তা তিনি অস্বীকার করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল সেখানে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ যে মিথ্যা তা উল্লেখ করেছেন। এমনকি তিনি এটাও বলেছেন, পাকিস্তান সরকার বদ্ধপরিকর যেকোন জঙ্গি গোষ্ঠী সম্পূর্ণরুপে নির্মূলের জন্য।
কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে? আসুন একটু দেখে নেই। জাতিসংঘের তালিকায় থাকা ১৩০ জন জঙ্গি ও ২৫টি জঙ্গি সংগঠনের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান এবং তারা যে এখনো তাদের দেশেই রয়েছে সেটা হয়তো ইমরান খান ভুলে গেছেন, হয়তো ভুলে গেছেন পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র সরকার, যারা জাতিসংঘের নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা আল-কায়দাকে পেনশন দেয়। সবচেয়ে বড় সার্কাসটি ছিলো ইমরান খান যে নিউইয়র্কে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন সেই শহরটিই তাদের জঙ্গিবাদের সবচাইতে বড় ক্ষত চিহ্ন বহন করে চলছে, এই শহরটিতেই টুইন টাওয়ারের ধ্বংসযজ্ঞ রয়েছে যার মূল হোতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তান লালন পালন করেছিলো। বিশ্ববাসীই দেখেছে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লাদেন পাকিস্তানের খাইবার পখতুনের এবোটাবাদেই ছিলো। শুধু তাই না, এই নিউইয়র্ক শহরেই পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকের অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতায় কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে। এতোকিছু সহজেই কিভাবে ভুলে যায় পাকিস্তান! ভুলে যান ইমরান খান!
এখানেই শেষ না, ব্যক্তি ইমরান কিভাবে নিজের রাজনীতির সাথে জঙ্গিবাদী নেতাদের জড়িয়েছেন তা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার। পাকিস্তান ‘তেহরিকে ইনসাফ পার্টি’ বা পিটিআই গঠনকালে ইমরানের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন তালেবান ও আল-কায়েদা। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল জামায়াত-ই-ইসলাম ও কওমি ওয়াতানের সঙ্গে আঁতাত করে খাইবার পাকতুনখোওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এটা হচ্ছে সেই খাইবার পাকতুনখোওয়া, যেখানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ওসামা বিন লাদেনকে লালন করেছিলো। এখানেই আল কায়েদার শক্তিশালী ঘাঁটি, যা এখনো বিদ্যমান। নির্বাচনে তাকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল তালেবান ও আল-কায়েদা গোষ্ঠী। মোল্লা ওমর ও জালালুদ্দিন হাক্কানির মতো তালেবান জঙ্গিরা তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকেই পড়াশোনা করেছে। এমনকি এবারের নির্বাচনেও পাকিস্তানে ধর্মীয় ডানপন্থীদের সরাসরি আনুকূল্য পেয়েছে ইমরান। ‘তালেবানের জনক’ খ্যাত মাওলানা সামিউল হক ইমরানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তবে এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি সামি উল হকের সঙ্গে জোট বেঁধে। চলতি মাসের শুরুর দিকে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-মুজাহিদিন প্রকাশ্যেই ইমরান খান ও তার দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের সাথে হাত মেলানো কোন রাষ্ট্রপ্রধান যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলবেন তখন সেটা নিতান্তই হাসির খোরাক। আয়নায় ইমরান খান হয়তো নিজের চেহারাটা দেখেননি, চেহারাটা দেখলে ভুলোমনা ইমরান খান হয়তো নিজেকে চিনতে পারতেন, চিনতে সহজ হতো তার জাতকেও!
‘ইসলাম এবং মুসলিম’ শব্দ চয়নের মাধ্যমে ইমরান খান ধর্মান্ধতার নোংরা কার্ড খেলার চেষ্টা করেছেন। ইমরান খানের ৫০ মিনিটের বক্তব্যে ‘হিউমেন রাইটস’ শব্দটি যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র ৪ বার পক্ষান্তরে ‘ইসলাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মোট ৭১ বার! তার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রায় প্রতি দেড় মিনিটে দুইবার তিনি ইসলাম শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। এটা মন্দ তা আমি বলছি না বরং অতি ভক্তি যে চোরের লক্ষণ তা একটু উদাহরণ দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছি, এটা যে কতো বড় ভণ্ডামি তা একটু দেখুন। ইমরান খান কাশ্মীরের মুসলমানদের নিয়ে বলেছেন, কিন্ত চীনে শত বছর যাবত মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের নির্যাতন নিয়ে টু শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। কিন্তু কেন? কারণ চীন তার বন্ধু রাষ্ট্র এবং ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনকে তার সবার আগে দরকার তাই। এমনকি সৌদি আরব দ্বারা ইয়েমেনে ঘটা স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা নিয়েও কিছুই বলেননি, কেননা সৌদি অর্থায়ন তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে।
জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মানবতার বুলি কপচানোর আগে নিশ্চয়ই একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। তার সে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে বাংলাদেশে সংঘটিত সবচেয়ে কম সময়ে বড় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাননি। সুযোগ ছিলো পাপমুক্ত হওয়ার। গোড়া কেটে দিয়ে আগায় পানি ঢাললে তো হবে না। আর তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে চাইলে তাকে আগে পাপমুক্ত হয়ে আসতে হবে। সেটা করার জন্য তাকে অবশ্যই নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাসের বর্বরোচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য। এই ‘ইসলাম আর মুসলিম’ শব্দচয়নে যারা গলে যাচ্ছেন তাদেরকে ভালো করে একাত্তরের সময়টার কথা স্মরণ করাতে চাই। এই দুটি শব্দ চয়নের মাধ্যমেই পাকিস্তান আমাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিলো, ইমরান খান নিয়াজির দুঃসম্পর্কের চাচা আমীর আব্দুল্লা খান নিয়াজীর হাত রাঙা হয়েছিলো আমাদের রক্তে।
জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ৭১ বার ‘ইসলাম’ শব্দ উচ্চারণ করলেই একাত্তরের ক্ষত মুছে যাবে না, গণহত্যা মিথ্যা প্রমাণিত হবে না। বরং একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য ৭১ বার ক্ষমা চাইলে কিছুটা পাপমোচন হতো। পাকিস্তান তার ধর্মীয় কার্ড খেলেছে, আর অনেকেই তাকে মুসলিম উম্মাহর নেতা বানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে, তার পূজো দিতে শুরু করেছে। কেনো এতো দৈন্যতা আমাদের? নিজ দেশের ইতিহাস, পাকিস্তানের বর্বর ও নির্মম ইতিহাস জানি না বলেই কি আমরা এতোটা নিম্নরুচি নিয়ে বেড়ে উঠছি। সবশেষে বলবো, জাতিসংঘের মঞ্চে মেকি মানবতা দেখে বিগলিত না হয়ে ইমরান খান এবং পাকিস্তানের ইতিহাস জানুন, নিজের ইতিহাস জানুন, নিজেকে চিনুন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 
বিডি-প্রতিদিন/মাহবুব
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        