ইংরেজিতে একটা কথা আছে, "A gentleman is what his tailor makes of him." দর্জি যদি ভদ্রলোক তৈরি করতে পারেন, তা'হলে একটি দেশও তৈরি সাধারণ মানুষের হাতে, অতি মানবের হাতে নয়।
আওয়ামী লীগ সত্যিকার অর্থেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি দল। এ জন্যই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। এ নেতৃত্বের সাফল্যের মূলে ছিলো দেশপ্রেম ও আদর্শ। শোষিত বঞ্চিত মেহনতী মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা শুধু বক্তৃতায় ব্যক্ত নয়, অন্তরে গাঁথা ছিলো। তরুণ নেতৃত্বই দেশবাসীকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে প্রস্তুত করে ছিলো। রাজনীতি না থাকলে কোনো দেশ অগ্রসর হতে পারবে না। পৃথিবীর কোন দেশই তা পারেনি। রাজনীতির মূল্যবোধ ও চেতনাকে ধ্বংস করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে।
বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের স্তরে যেভাবে পৌঁছে দিয়েছেন, ঠিক রাজনীতির উন্নয়নটা যদি সেভাবে করতে পারতেন, তাহলে তাঁর অনুপস্থিতিতেও দেশ শূন্যতা অনুভব করতো না। হয়তো অনেকে আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করতেও না পারেন, কিন্তু এটা তো সত্য যে, আমাদের সামনে এখনো পর্যন্ত একটি ছায়া নেতৃত্বের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি কল্পনা করলে আমার চোখে অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাই। সেই অন্ধকার ধ্বংসের, প্রতিহিংসার এবং চরম বিপর্যয়ের।
যাহোক, করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর চোখেমুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থাকলেও পরম আশার বাণীও আছে। সরকারের মন্ত্রী ও এমপিরা মানবিকতার হাত কতটা প্রসারিত করেছেন? এটা যেমন প্রশ্ন, তেমনি এ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে কতটা যোগত্যার প্রমাণ দিচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে অদক্ষ অযোগ্য মন্ত্রীদের নাম ধরে ধরে তাদের বাদ দেয়ার দাবি উঠেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। করোনা শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন তাদেরও প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে করোনা। রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা হারিয়েছি। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত
বিশেষ বুলেটিনই এখন দেশবাসীর জন্য হয়ে গেছে প্রধান খবর। এছাড়া জনগণের চোখ খোঁজে সরকারের কর্মকাণ্ড। কজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন, যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন? এর সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু এমন কোনো ভূমিকা দেখছি না, যা রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে। আমরা সত্যিকারের রাজনীতি দেখতে চাই।
রাজনীতি দোষণীয় নয়, বরং একটি পবিত্র ব্রত। ব্রতগ্রহণের প্রেরণা প্রাণে জন্মে সাধারণ মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষা থেকেই। রাজনীতির চোহারা দেখে কি মনে হয়, রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি করছেন?
ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ কাউন্সিল উদ্বোধন করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। বাঙালি মুক্তির সনদ ৬ দফার আন্দোলনে উত্তাল তখন পূর্বপাকিস্তান। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। ওই সংকটের মুখে বিশেষ কাউন্সিলটি অনুষ্ঠিত হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেছিলেন, "যারা রাজনীতিকে ভাগ্যোন্নতির অবলম্বন বলে ভাবেন, তাদের উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করা, কন্ট্রাক্টরি করা, লাইসেন্স বা পারমিটের জন্য উমেদারি করা, কিন্তু রাজনীতি করা নয়। রাজনীতির একটিমাত্র অপাপবিদ্ধ উদ্দেশ্য, দেশ ও মানুষের কল্যাণ। কল্যাণসাধনের পথ বিঘ্নসঙ্কুল। এ পথে নিত্য উদ্যত দমন ও পীড়নের খরগ। গতানুগতিক বা প্রথাসিদ্ধ রাজনীতি নয়- সত্যিকার রাজনীতির বিঘ্নসঙ্কুল পথে যারা অভিযাত্রী, তারা মহাপ্রাণ, তারা শ্রদ্ধেয়। ক্ষুদ্রস্বার্থের বিচারবোধ বা নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ পন্ডিতি বুদ্ধির চুলচেরা তর্কের মাধ্যমে তাদের কল্যাণবোধ ও মনুষ্যত্ববোধের পরিমাপ সম্ভব নয়।"
তফাজ্জল হোসেন মানিক ঠিকই বলেছিলেন, গণকল্যাণের রাজনীতি আর ক্ষমতার রাজনীতি এক নয়। রাজনীতি সুনিশ্চিতভাবে ক্ষমতালাভের উপায়, কিন্তু উদ্দেশ্য নয়। যারা একে উদ্দেশ্য করে তোলেন তারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন, গণকল্যাণের রাজনীতি করেন না।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু দুঃখ-ত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় নবতর এক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সেই অগ্নিপরীক্ষায় ইস্পাত-দৃঢ় মনোবল ও দেশপ্রেম দেখিয়েছেন বলেই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ এবং জনগণও একাট্টা হয়ে গিয়েছিলো। রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে ছিলো বলেই মুক্তির সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে। একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে।
দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা বা ভাগ্যনির্দেশকের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দেশপ্রেম, সততা, দুর্জয় সাহস, সদিচ্ছা সর্বোপরি তার সত্যপ্রকাশে দূরন্ত সাহস তার নেতৃত্বে পরোতে পরোতে ফুটে উঠেছে। কঠোর হস্তে দমনের অজস্র দৃষ্টান্তও তিনি দেখিয়েছেন বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। মন্ত্রী এবং এমপিদের রাজনৈতিক গুণাবলী থাকলে তাদের আচার-আচরণে ও কর্মে তার প্রতিফলন নিশ্চয়ই জনগণ দেখতে পাবে। কিন্তু ক'জনার মাঝে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলী রয়েছে?। কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে মন্ত্রী-এমপিরা সরকার প্রধানের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা আনুগত্য প্রকাশ করুন। স্বার্থ হাসিলের জন্য তোষামোদি, বন্দনা চাটুকারিতা পরিহার করে দেশকে ভালোবাসুন। জনগণের সেবা করুন। তবে রাজনীতি বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন
