১৮ অক্টোবর, ২০২০ ১৪:৪২

অসংক্রামক রোগ ও কোভিড-১৯ জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার

অসংক্রামক রোগ ও কোভিড-১৯ জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার

কোভিড-১৯ শুধু লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুসহ বিভিন্ন দুর্ভোগেরই কারণ হয়নি, এই মহামারিটি অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে তেমনি জনগোষ্ঠীর বাড়তি মৃত্যু হারের উপরও যথেষ্টে প্রভাব ফেলেছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো কোভিড-১৯ সৃষ্ট সামগ্রিক বিপর্যয়ের কারণে জনগণ স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইদানিংকালে সম্পাদিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে স্বাস্থ্য সেবাটি সবচেয়ে বেশি ব্যতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন ধরণের অসংক্রামক ব্যাধির শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা।

ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ পূর্ব অবস্থার চেয়ে বর্তমানে অসংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসা গড়ে ৬৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ৫-৬ মাসে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়ের যে চিত্র আমরা দেখেছি তাতে করে এটা ভাবার অবকাশ নাই যে দেশটিতে অসংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসা বিপর্যয়ের এই চিত্রটা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংগৃহীত বৈশ্বিক চিত্রের চেয়ে কোন অংশে ভালো।

বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংক্রামক ব্যাধিতে ৮ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, যা বিভিন্ন কারণে মোট মৃত্যুর ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে হৃদরোগে মারা যায় ১৭ শতাংশ, ফুসফুসের দীর্ঘকালীন প্রদাহে মারা যায় ১১ শতাংশ, ডায়াবেটিসে মারা যায় ৩ শতাংশ এবং ক্যানসারে ভুগে মারা যায় ১০ শতাংশ। বাদবাকি ১৮ শতাংশ মারা যায় অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধিতে ভুগে। বাংলাদেশে মৃতের এই হারকে আমলে নিলে অসংক্রামক ব্যাধি বিশেষ করে হৃদরোগ, ফুসফুসের দীর্ঘকালীন প্রদাহ, ক্যানসার এবং ডায়াবেটিসের বিস্তার এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের কাররেই কোন সন্দেহ থাকার কথার নয়।

অসংক্রামক ব্যাধিতে ভোগার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে এবং ব্যক্তি বিশেষে কারণগুলোর ভিন্নতা থাকবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ধূমপান, ফল এবং সবজি জাতীয় খাদ্যের স্বল্পতা, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা, শরীরের ওজন বৃদ্ধি বা স্থূলতা, পেটে মেদ জমা, উচ্চ রক্ত চাপ এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা (প্রি-ডায়াবেটিস)। খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, নিজ ঘরে অথবা দু’একটি নিকটাত্মীয়ের পরিবারের মধ্যেই হয়ত এসব রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভোগা একাধিক সদস্যদের সন্ধান পাবেন। 
কোভিড-১৯ সৃষ্ট চিকিৎসা বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ দুঃসংবাদ বিশেষ করে যারা হৃদরোগ, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এবং বহুমূত্র রোগে ভুগছেন। এই সব রোগী অতীত অভিজ্ঞতালব্ধ আস্থাহীনতার কারণে এবং নতুন ভাবে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ক্লিনিকে বা হাসপাতালে যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে সাধারণ জনগণের একটা দূরত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দূরত্বটা পূর্বেও ছিল, কিন্তু কোভিড-১৯ এই দূরত্বটা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকে ভয়-ডরকে পিছনে ফেলে কোনভাবে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার আশায় হাসপাতালে গেলেও বিভিন্ন কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী চিকিৎসা পাচ্ছে না। চিকিৎসা না পাওয়ার প্রধান কারণ হলো চিকিৎসক বিশেষ করে অভিজ্ঞ ঊর্ধ্বতনদের অনুপস্থিতি এবং ওষুধসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর স্বল্পতা।

ক্ষমতাধর অথবা বিত্তবানরা হয়ত কিছুটা হলেও সেবা পান, কিন্তু দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা যে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে কোনই সন্দেহ নাই। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অনুমান করা হচ্ছে যে ৫৩ শতাংশের ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপ জনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা হয়ত একেবারেই হচ্ছে না অথবা গুরুতরভাবে বিঘি্নত হচ্ছে, ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে বহুমূত্র অথবা তার সাথে সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা বিঘি্নত হচ্ছে, ৪২ শতাংশ ক্যানসার রোগী সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না এবং ৩১ শতাংশ হৃদরোগের আক্রান্ত ব্যক্তি জরুরি চিকিৎসা পাচ্ছে না। এবং এসবই হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতে কোভিড-১৯ সৃষ্ট অব্যবস্থাপনার কারণে। অনেক ক্ষেত্রেই কোভিড-১৯ মহামারীকে সামাল দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত চিকিৎসা সেবাকে বাতিল করা হয়েছে। সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা প্রদানে আগ্রহ হারিয়েছে। এছাড়াও ওষুধের স্বল্পতা, স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাব, হাসপাতালে সংক্রমণ রোধে ব্যবস্থাপনার অভাব তো আছেই।

সহসাই যে পৃথিবী কোভিড-১৯ মুক্ত হবে না তা এতদিনে আমাদের সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরাও তাই বলছেন। সমগ্র বিশ্ব কোভিড-১৯ প্রতিষেধক ভ্যাকসিনের অপেক্ষায়। ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন হলেও আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের পূর্বে তা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে কেউই মনে করেন না। ভ্যাকসিন আসলেও তা কতটা কার্যকর হবে, কতদিনের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে কি না, সেগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং সন্দেহ  বিশ্বব্যাপী সবার মধ্যেই আছে। তবে ভ্যাকসিন যে কোন স্থায়ী সমাধান নয় তা সবার কাছেই স্পষ্ট।

এই কারণে আমাদের ধরেই নিতে হবে যে কোভিড-১৯ অন্যান্য রোগের মত একটি রোগ হয়ে আমাদের সাথে থাকবে এবং আমাদের শিখতে হবে কিভাবে এমন একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগের উপস্থিতি মেনে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হয়। স্বাস্থ্য খাতের সকল স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাতেই কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি অসংক্রামক রোগের শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসাকে অন্তর্ভুক্ত করতে  হবে। মনে রাখতে হবে বয়স্ক ব্যক্তিদের অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি এবং এই ধরণের পূর্ব রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে রোগের ভয়াবহতা এমনকি মৃত্যু সম্ভাবনাও অন্যের তুলনায় অনেক বেশি।

বাংলাদেশের জন্য এখনই যেটা প্রয়োজন সেটা হলো কোভিড-১৯ রোধে সার্বজনীন বিস্তৃত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। অসংক্রামক ব্যাধির শনান্তকরণ এবং চিকিৎসা এই কর্মপরিকল্পনারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং এটির বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক ভাবে তুলনা করা যায় এমন অনেক দেশ এ ধরমের কর্মপরিকল্পনা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে এবং প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশও পারবে না সে রকম টা আমরা ভাবতে চাই না।

জিয়াউদ্দিন হায়দার: ঊর্ধতন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ,  বিশ্ব ব্যাংক 

বিডি প্রতিদিন/আল আমীন

 

সর্বশেষ খবর