১৫ মার্চ, ২০২১ ১০:০৩

এক যুগে পদার্পণ আরও যুগ যাবে

তসলিমা নাসরিন

এক যুগে পদার্পণ আরও যুগ যাবে

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশ  প্রতিদিন ১২ বছরে পা দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি আনন্দের দিন। এভাবেই ১২ বছর পর আরও ১২ বছর পার করবে প্রতিদিন, তারপর আরও ১২ বছর, তারপর ১০০ বছর। তারপর হাজার বছর। আমি থাকবো না, প্রতিদিনে যারা এখন কাজ করছেন, তাঁরাও থাকবেন না। কিন্তু প্রতিদিন থাকবে। ভাবলে কী আশ্চর্য ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে। আর্কাইভ থেকে ১০০ বছর পর হলদে হয়ে যাওয়া পত্রিকা বের করে আমাদের উত্তরসূরিদের কেউ কেউ হয়তো গবেষণা করবেন। আজকাল অবশ্য অন্তর্জালেই সংরক্ষণ করা যায় যাবতীয় লেখালেখি। তারপরও পুরোনো কাগজ হাতে নেওয়ার আনন্দ অন্যরকম।

আজ অবাক হই, এই করোনাকালেও একটি দিনের জন্যও বাংলাদেশ প্রতিদিন বন্ধ থাকেনি। একটি পৃষ্ঠাও কম ছাপানো হয়নি। পৃথিবীর খুব বড় বড় পত্রিকাও মানবজাতির এই চরম দুঃসময়ে কলেবর ছোট করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাহসী যোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনার খবর ছাপিয়ে গেছেন গত একটি বছর। এঁদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। স্বয়ং সম্পাদকও হয়েছেন, কিন্তু প্রতিদিনকে একটি দিনের জন্যও আক্রান্ত হতে দেননি। একটি দিনের জন্যও এর গায়ে অসুস্থতার দাগ পড়তে দেননি।

আগেও বলেছি, আজও বলছি প্রতিদিনে লিখলে আর কোনও পত্রিকায় লেখার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিদিনের খবর পড়লে আর কোনও পত্রিকার খবর পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিদিন একাই একশ’। আমরা যারা নিয়মিত প্রতিদিনে লিখি আমরা অলিখিত ভাবেই প্রতিদিনের পরিবার। প্রতিদিনের প্রকাশক সম্পাদক সাংবাদিক- সবাই অলিখিত ভাবেই প্রতিদিনের পরিবার, প্রতিদিনের প্রাণ।
আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখি- এ আমার গৌরব। আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে প্রতিদিন। আজ ২৬ বছর দেশ থেকে নির্বাসিত আমি। দেশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ২৬ বছর। ২৬ বছর আমি দেশের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। দেশের রূপ রস গন্ধ থেকে বঞ্চিত। আমার আত্মীয় স্বজন থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন আমাকে স্পর্শ দিচ্ছে দেশের। প্রতিদিনের পাঠকই আমার স্বজন বন্ধু। প্রতিদিনের পরিবারই আমার পরিবার। প্রতিদিনই আমার দেশ।

অনেকে বলবে খামোকাই অতি আবেগ আমার। কিন্তু যারা বিনা অপরাধে নির্বাসন-জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, তাদের আবেগ সাধারণ মানুষের আবেগের মতো নয়। প্রায় দু’যুগ পর আমার হারিয়ে যাওয়া দেশকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে প্রতিদিন। প্রতিদিনের জন্য আমার আবেগ, সত্যি বলতে কী, আরও অনেক গুণ বেশি, যতটা আমি প্রকাশ করছি এখন, তার চেয়ে। দেশের প্রতি আমার অভিমানকে দূরে সরিয়েছে প্রতিদিন। দেশের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই দূরত্বকেও ঘুচিয়েছে প্রতিদিন। প্রতিদিনই এখন আমাকে প্রতিদিন দেশের খবর দেয়। দেশের প্রতি আবার আগ্রহ-উৎসাহ জাগাচ্ছে প্রতিদিনই।

 

লেখকের লেখা ছাপানোর অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে লেখককে মেরে ফেলার আয়োজন করা। আমাকে তো মেরেই ফেলা হচ্ছিল। এই সময় যদি প্রতিদিন এসে না দাঁড়াতো, প্রতিদিন এসে যদি হাত না বাড়াতো, আমি হয়তো একটু একটু করে অদৃশ্যই হয়ে যেতাম। প্রতিদিনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোনও শেষ নেই, কোনও সীমা নেই। প্রতিদিন বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা। সব রকম মানুষ প্রতিদিন পড়ে। শিক্ষিত অল্পশিক্ষিত, নারী পুরুষ, গরিব ধনী, মালিক শ্রমিক-সব রকম। যে পত্রিকা সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে, সে পত্রিকাই পত্রিকা হিসেবে সার্থক। ভাবলে আনন্দ হয় যে বাংলাদেশের ৩৪৫টি দৈনিক পত্রিকার মধ্যে প্রতিদিনের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। এত অল্প সময়ে দেশের এক নম্বর পত্রিকা বনে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। প্রতিদিনে পড়ার সব আছে। সব শ্রেণীর, সব বয়সের, সব রুচির মানুষের পড়ার বিষয় আছে প্রতিদিনে। আমি প্রতিদিন পড়ি অনলাইনে। খুব ইচ্ছে করে কাগজের পত্রিকা হাতে নিতে। কিন্তু সে সম্ভব নয়। শুধু প্রতিদিন নয়, অন্যান্য পত্রিকাও আজকাল অনলাইনে পড়া হয়। পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। খবরের কাগজ কিনে মানুষ হয়তো ভবিষ্যতে আর খবর পড়বে না।

প্রতিদিনের সমস্ত কর্মীকে আজ আমি অভিবাদন জানাচ্ছি। প্রতিদিনের জন্য আমার লক্ষ শুভেচ্ছা, কোটি শুভকামনা। যতদিন আমি লিখবো প্রতিদিনে, ততদিন শুভকামনায় ডুবিয়ে রাখবো একে। আমি না লিখলেও, না থাকলেও আমার শুভকামনা থাকবে। প্রতিদিন আরও হাজার বছর নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকুক। আরও হাজার বছর মিথ্যে নয়, সত্য খবর ছাপুক। আরও হাজার বছর প্রতিদিন তার পাঠককে ভাবনার খোরাক দিক, মুক্ত চিন্তা দিক। আরও হাজার বছর জ্ঞান দিক, শক্তি দিক। আরও হাজার বছর পাঠককে তাদের ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ দিক। যে পত্রিকা শুধু একপেশে মত প্রকাশ করে, সেই পত্রিকা নিয়ে গৌরব করার কিছু নেই। চারদিকে তেমনই পত্রিকা দেখি। হয় বাম, নয় ডান, হয় আমার দলে, নয় তোমার দলে।

প্রতিদিন নিয়ে আমি গৌরব করি, প্রতিদিন সবার সব রকম মত প্রকাশ করে। প্রতিদিন ডানে না বামে না। যতটুকু নিরপেক্ষ হওয়া দরকার, প্রতিদিন ততটুকুই নিরপেক্ষ।

সর্বশেষ খবর